ছেলেকে নামিয়ে দেই তার কর্মস্থলে। কর্মস্থল বলতে বেতনবিহীন চাকুরি। আসছে সেপ্টেম্বরে সে হাইস্কুলে যাবে। নাইন, টেন, ইলেভেন, টুয়াল্ভ এই চার ক্লাসকে এদেশে হাইস্কুল বলে। নিয়মানুযায়ী এই সময়ের মধ্যেই তাকে দু'শত ঘণ্টা ভলান্টিয়ার জব করতে হবে। যেহেতু এবারের গ্রীষ্মের ছুটিতে তার পড়ার চাপ নেই, তাই ডাক্তারের অফিসে ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজে লাগিয়ে দেয়া।
ফিরবার তাড়া না থাকলে পাশের গাছগাছালি ঘেরা ছোট্ট পার্কটিতে বসে থাকি একরাশ ভালোলাগা নিয়ে।হেডফোনে গান শুনি, শিশুদের ছুটোছুটি দেখি, একপাশে কিছু হোমলেস হা হা হো হো শব্দে গল্পে মশগুল, তাদেরও দেখি। নিরিবিলিতে গান শুনবার সময় একই বেঞ্চিতে ও মাথায় একমনে বসে থাকা বৃদ্ধের দিকে চোখ পড়ে। আবারো ফিরে চাই। এ তো এমদাদ ভাই! ২০ বছর আগে এদেশের প্রথম দিকের সময়গুলোতে আমি যে গ্রোসারি দোকান থেকে বাজার করতাম, উনি সেখানকার "মিট কাটার" ছিলেন। কতো যত্ন করে আমায় ভালো মাছ, মাংসটুকু দিতেন। কাজের ফাঁকে টুকটাক জীবনের গল্প বলতেন।
জাহাজে চাকুরি করতেন একসময়। জাহাজ আমেরিকায় ভিড়লে আরও অনেকের সাথে তিনিও থেকে যান। দীর্ঘদিন ব্রুকলিনে কন্সট্রাকশনের কাজ করেছেন। বৈধভাবে এদেশে থাকবার উদ্দেশ্যে চুক্তিতে অর্থের বিনিময়ে বিয়ে করেছেন এক বিদেশিনীকে। গ্রিনকার্ড পাবার পর চুক্তি মোতাবেক যে যার পথে। দেশে গিয়ে বিয়ে করেছেন সবকিছু জানিয়েই। স্ত্রীকে এদেশে আনেন। পরবর্তীতে নিজের এবং স্ত্রীর ভাইবোনদের আনবার জন্যে আবেদন করেন। এ পর্যন্ত আমি জানতাম। তারপর দীর্ঘ এতোগুলো বছর আর দেখা নেই।
আজ হঠাৎ দেখায় একটু হতবাক হলাম। অনেকটা বুড়িয়ে গেছেন। পকেট থেকে ইনহেইলার বের করে নিতে নিতে বললেন, কন্সট্রাকশনের কাজের প্রভাবে এই শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা। জানতে চাইলাম, ভাইবোনরা শেষ পর্যন্ত এদেশে এসেছিলো ? কিছুটা স্বস্তির সাথেই বললেন, সবাই এসেছে, গুছিয়ে নিয়েছেন, যার যার মতো করে বেশ আছেন। তাদের সন্তানরা এদেশের স্কুল, কলেজ পাশ করেছে। কেউ কেউ ভালো চাকুরি করছে। অদ্ভুত এক বিষণ্ণ হাসি দিয়ে বললেন, আমি মূর্খ সুখ্য মানুষ, ছোট কাজ করি, ভাগিনারা আমার পরিচয় দিতে লজ্জা বোধ করে।
গল্পের এ পর্যায়ে আমার এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের কথা মনে পড়ে গেলো। যিনি একদিন খুব উন্নাসিকভাবে বলেছিলেন, 'ওপি, ডিভি লটারির মাধ্যমে যারা এদেশে এসেছেন, তাদের ঘেন্না হয় আমার, যত্তোসব মূর্খের দল।' আমি জানতে চেয়েছিলাম, আপনি কিভাবে এসেছেন ? খুব গর্বের সাথে জানালেন, ইমিগ্রেণ্ট হয়ে এসেছি, ভাই আবেদন করে এনেছেন। আবারো জিজ্ঞেস করি, ভাই কিভাবে এসেছেন ? এবার কিছুটা আড়ষ্ট হয়ে বললেন, ওপি ওয়ান লটারিতে।
ততক্ষণে ছেলের মেসেজ ভেসে উঠে স্ক্রিনে, মা তুমি কোথায়? আমাকে নিয়ে যাও। বিকেল সাতটায় কাজ শেষ হয়েছে।' আমি উঠে দাঁড়াই। অনর্থক সান্ত্বনা দিয়ে এমদাদ ভাইকে বলি, 'একদিন ওরা ঠিকই বুঝতে পারবে।' তিনি লম্বা শ্বাস নিয়ে বললেন, 'হুম, বুঝবে, অবশ্যই বুঝবে, হয়তো বুঝবে।' রাস্তার কিনারে পার্ক করা গাড়ির দিকে যেতে যেতে শুধু শুনলাম, বুঝবে... বুঝবে...
গাড়িতে বসে কাঁচের হুডের উপরে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি দেখি। হুট করেই ঝুম বৃষ্টি নামলো, আবার হুট করেই আকাশ পরিস্কার হয়ে রোদ উঠলো। জানালার কাঁচ নামিয়ে এক চিলতে আকাশ দেখি। খণ্ডখণ্ড মেঘের আকাশ। ভাবি, একজন মানুষ কঠিন যুদ্ধ করে অকৃপণভাবে এদেশে থাকবার যে রাস্তাটি সহজ করে গিয়েছেন পরিবারের অনেকগুলো মানুষের জন্যে, তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যে, সে কতোটা শ্রদ্ধেয়! মাথা নত হয়ে আসে।
আমি বিশ্বাস করি, কখনো কখনো কারো কিছু পাওয়ার পিছনে অন্য কারো হারানোর গল্প থাকে।
যে গল্পগুলো বুক চেরা দীর্ঘশ্বাসের নিচে চাপা পড়ে থাকে অনন্তকাল।
শুভকামনা সকলকে...
(লেখকের ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)
বিডি প্রতিদিন/১২ জুলাই, ২০১৭/ফারজানা