রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেছেন, গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখা এবং উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনের চ্যালেঞ্জ নিয়ে প্রতিকূলতার মধ্যে সরকারকে কাজ করতে হচ্ছে। দেশের মাটি থেকে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ নির্মূল করতে বর্তমান সরকার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। বিগত মেয়াদের ধারাবাহিকতায় বর্তমান সরকার এ লক্ষ্য অর্জনে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এর ফলে দেশে নাশকতামূলক কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণে এসেছে এবং জনজীবনে স্বস্তি বিরাজ করছে। নানা প্রতিকূল পরিস্থিতি সত্ত্বেও দেশে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও ভারসাম্য রয়েছে। দেশে বিনিয়োগ পরিস্থিতির অনুকূল পরিবেশ বিরাজ করছে।’
স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে গতকাল জাতীয় সংসদে দেওয়া ভাষণে রাষ্ট্রপতি এ কথা বলেন। ইংরেজি বছরের প্রথম অধিবেশনে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতায় রাষ্ট্রপতির ভাষণ দেওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি সকল সংসদসদস্য ও দেশবাসীকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানান। এসময় সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ, জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, তিন বাহিনীর প্রধান, বিদেশি মিশনসমুহের কূটনীতিকরা অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন।
সংসদে দেওয়া বক্তব্যে রাষ্ট্রপতি সরকার ঘোষিত ভিশন-২০২১ এবং ভিশন-২০৪১ অর্জনে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, ‘২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে বাংলাদেশ মধ্য-আয়ের দেশে পরিণত হবে এবং ২০৪১ সালে বিশ্বসভায় একটি উন্নত দেশের মর্যাদায় অভিষিক্ত হবে, এটাই জাতির প্রত্যাশা। আমি দৃঢ়ভাবে আশাবাদী, রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বস্তরে সুশাসন সুসংহতকরণ, গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ এবং জনগণের সর্বাত্মক অংশগ্রহণের মাধ্যমে আমরা এসব লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হব।’
রাষ্ট্রপতির দেওয়া ৪০ মিনিটের এই ভাষণে রাষ্ট্রপতি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় যুদ্ধাপরাধের চলমান বিচার এবং শিশু রাজন ও রাকিব হত্যা মামলার দ্রুত বিচার হওয়ার দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদাঢিক চেতনা ও ক্ষুধা, দারিদ্রমুক্ত ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার আহ্বান জানান। রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘২০১৪ সালে অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের পর শত প্রতিকূলতা, বাধা-বিপত্তি ও বৈরিতার মধ্যেও দেশে সুশাসন সুসংহতকরণ এবং গণতন্ত্র চর্চা ও উন্নয়ন কর্মসূচিতে তৃণমূল থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সরকারের প্রয়াস অব্যাহত রয়েছে।’
আবদুল হামিদ বলেন, ‘সরকারের কৃষিবান্ধব পদক্ষেপের ফলে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়নের মডেল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি ৬.৫ ভাগে উন্নীত হয়েছে। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ইপিজেডে ৩ হাজার ৭৪৭ মিলিয়ন মার্কির ডলার বিনিয়োগ হয়েছে। ৪ লক্ষ ৩৯ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। তিনি বলেন, ‘বিশ্ব-অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে চলমান সঙ্কট এবং অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে উদ্ভূত নানা প্রতিকূল পরিস্থিতি সত্ত্বেও যথোপযুক্ত রাজস্ব নীতি ও সহায়ক মুদ্রানীতির প্রভাবে দেশে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও ভারসাম্য বজায় রয়েছে।’
বিশ্ব-অর্থনীতিতে বৈদেশিক বাণিজ্যের শ্লথগতি এবং উন্নত দেশগুলোর অর্থনৈতিক স্থবিরতার কারণে সেসব দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা ব্যাপক কমে যায়। এর কিছুটা প্রভাব বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যে প্রতিভাত হলেও সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করায় দেশের রপ্তানি বাণিজ্যে প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত আছে বলে জানান আবদুল হামিদ। তিনি বলেন, ‘রেমিট্যান্স প্রবাহ ৭ দশমিক ছয় শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ১৫ দশমিক তিন বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং সর্বশেষ ৩১ ডিসেম্বর ২০১৫ তারিখে ২৭ দশমিক চার-পাঁচ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে। মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হারও স্থিতিশীল রয়েছে।’
রাষ্ট্রপতি আরো বলেন, ‘বর্তমান সরকার শুরু থেকেই গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখা এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনের চ্যালেঞ্জ নিয়ে দেশ পরিচালনা করছে। বর্তমান সরকার দায়িত্বগ্রহণের পর থেকেই গণতন্ত্রের বিকাশ, আইনের শাসন ও আর্থ সামাজিক সমৃদ্ধিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সুশাসন সুসংহত করার নিরলস প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। আমার বিশ্বাস সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনে শান্তি, শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখবে।’ ভাষণে রাষ্ট্রপতি অর্থনীতি, বাণিজ্য-বিনিয়োগ, খাদ্য-কৃষি, পরিবেশ-জলবায়ু, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন খাতে সরকারের কার্যক্রম ও সাফল্য তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি উন্নয়নের এ ধারা অব্যাহত রেখে সরকার নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হবে।’ এছাড়া মানব পাচার, সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় সরকারের পদক্ষেপের প্রশংসা করেন।
রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘দেশের মাটি থেকে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ নির্মূল করতে বর্তমান সরকার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। বিগত মেয়াদের ধারাবাহিকতায় বর্তমান সরকার এ লক্ষ্যে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এর ফলে দেশে নাশকতামূলক কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণে এসেছে এবং জনজীবনে স্বস্তি বিরাজ করছে।’ সরকার রাজনীতি থেকে হিংসা, হানাহানি অবসান করতে চেষ্টা করছে মন্তব্য করে আবদুল হামিদ সরকার ও বিরোধী দলকে কার্যকর ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান।
আবদুল হামিদ আরো বলেন, ‘একাত্তরের শহীদদের কাছে আমাদের অপরিশোধ্য ঋণ রয়েছে, আসুন ধর্ম-বর্ণ- গোত্র নির্বিশেষে এবং দল-মত-পথের পার্থক্য ভুলে জাতির গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার মাধ্যমে আমরা লাখো শহীদের রক্তের ঋণ পরিশোধ করি। ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত গৌরবোজ্জ্বল স্বাধীনতা সমুন্নত এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুজ্জ্বল রাখতে, গণতন্ত্র ও আইনের শাসন সুদৃঢ় করতে এবং শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলতে, বাঙালি জাতিকে আবারও ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে।’
অধিবেশন শুরুর পর স্পিকার রাষ্ট্রপতির আগমনের ঘোষণা দিলে সশস্ত্র বাহিনীর একটি বাদক দল বিউগলে ‘ফ্যানফেয়ার’ বাজিয়ে রাষ্ট্রপতিকে সম্ভাষণ জানান।
সংসদ কক্ষে রাষ্ট্রপতির ঢোকার পর নিয়ম অনুযায়ী জাতীয় সংগীত বাজানো হয়। সংসদে রাষ্ট্রপতির জন্য স্পিকারের পাশে লাল রঙের গদি সম্বলিত চেয়ার রাখা হয়।
স্পিকারের ঘোষণায় অনুরোধের পর রাষ্ট্রপতি তার লিখিত ভাষণের সংক্ষিপ্তসার পড়া শুরু করেন। এসময় তার মূল বক্তব্য পঠিত বলে গণ্য করার জন্য স্পিকার শিরীন শারমিনকে অনুরোধ জানান আবদুল হামিদ।
বিডি-প্রতিদিন/২০ জানুয়ারি ২০১৬/শরীফ