লকডাউন তুলে দেওয়ার পর দেশে বিবাহবিচ্ছেদের হার আবার বাড়তে শুরু করেছে। করোনা সংক্রমণ শুরুর প্রথমদিকে বিবাহবিচ্ছেদের হার তুলনামূলক কম ছিল। লকডাউনের মধ্যে এপ্রিলে কোনো বিচ্ছেদের আবেদন জমা পড়েনি ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে। কিন্তু লকডাউন শেষে জনজীবন কিছুটা স্বাভাবিক হতেই বিবাহবিচ্ছেদের হার আবার বাড়তে শুরু করেছে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারিতে বিচ্ছেদের হার বেশি থাকলেও ধীরে ধীরে এই সংখ্যা কমে আসে। জানুয়ারিতে উত্তর সিটি করপোরেশনে ৬১৮, ফেব্রুয়ারিতে ৪৪১ জন, মার্চে ৪৫৫ জন বিচ্ছেদের আবেদন করেন। লকডাউনের কারণে এপ্রিলে কোনো বিচ্ছেদের আবেদন জমা পড়েনি। মে মাসে ৫৪টি এবং জুন মাসে জনজীবন কিছুটা স্বাভাবিক হলে এই সংখ্যা বেড়ে ৬৩২ জনে দাঁড়ায়।
একইভাবে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৫২৮ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৪৪২ জন, মার্চে ৪৯২ জন বিচ্ছেদের আবেদন করেন। উত্তরের মতো দক্ষিণেও এপ্রিল মাসে বিচ্ছেদের কোনো আবেদন হয়নি। তবে মে মাসে ১১৩ জন ও জুনে ৪৪১ জন বিচ্ছেদের জন্য আবেদন করেন। উত্তর ও দক্ষিণে আবেদনকৃত নারী-পুরুষের মধ্যে নারীরা পুরুষের চেয়ে দ্বিগুণ হারে বিচ্ছেদের জন্য আবেদন করেন। আবেদনকারীর মধ্যে পুরুষের সংখ্যা ৩৫ শতাংশ এবং নারীর ৭০ শতাংশ। এ সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা সংক্রমণের মধ্যে মানুষের জীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়ায় কিছু দম্পতি বিবাহ বিচ্ছেদে না গিয়ে সাময়িক সমঝোতা করেন। কিন্তু যখন আবার সবকিছু স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে তখন তারা বিবাহবিচ্ছেদের পথে যাচ্ছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, লকডাউনে অনেকে ঘর থেকে বের হতে পারেননি। আবার অর্থনৈতিক অবস্থা ও অনিশ্চিত জীবনের কথা চিন্তা করেও অনেকে বিচ্ছেদে যাননি। কিন্তু লকডাউন শেষে বিচ্ছেদের হার বাড়তে শুরু করেছে। এক্ষেত্রে নারীরাই এগিয়ে আছেন। বিশেষ করে রাজধানীর অভিজাত পরিবারের শিক্ষিত ও অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী নারীরা বিচ্ছেদে অগ্রগামী রয়েছেন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য বলছে, ঢাকার চেয়ে দেশের অন্য বিভাগীয় অঞ্চল ও জেলা শহরগুলোতেও বিবাহ বিচ্ছেদের হার ও আশঙ্কা দুটোই বেশি। সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী, গ্রামের দম্পতিরা শহরের দম্পতিদের তুলনায় বিবাহ বিচ্ছেদে বেশি আগ্রহী। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রাজশাহী এলাকার মানুষ বিচ্ছেদের আবেদন করেন। এখানে বিচ্ছেদ আবেদনের হার প্রতি হাজারে ১ দশমিক ৭ ভাগ। ছোট একটি বিষয়ে গত বছরের ডিসেম্বরে শরিফুল ইসলাম সোহাগ ও সাইয়েদা আহমেদ দম্পতির ঝগড়া হয়। দাম্পত্য কলহের একপর্যায়ে সাইয়েদা তাদের তিন বছরের ছেলে স্বপ্নীলকে নিয়ে বাবার বাড়িতে চলে যান। এরপর করোনা সংক্রমণ শুরু হয়। সোহাগ এই সময়ে ছেলে ও স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করলেও ছেলের সঙ্গে বাবার কোনো যোগাযোগ করতে দেননি সাইয়েদা। আবার সোহাগের সংসারেও ফিরে আসতে চাচ্ছেন না সাইয়েদা। এই অবস্থায় হতাশ হয়ে চলতি আগস্ট মাসের শুরুতে বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন করেছেন সোহাগ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক সাদেকা হালিম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, জীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়ায় মহামারীর শুরুতে জীবনসঙ্গীরা একে অন্যের সঙ্গে সমঝোতা করে থাকলেও এটি ছিল সাময়িক। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও লকডাউন শেষে জনজীবন স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। যারা বিচ্ছেদের আবেদন করেছেন, তাদের অনেকেরই অর্থনৈতিক সঙ্গতি আছে বলেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কিছু পরিবার আবার কষ্টে থাকা মেয়েদের বিচ্ছেদে যাওয়ার সিদ্ধান্তকে নেতিবাচকভাবে আর দেখে না। তারা মেয়েটির সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেন, তার পাশে থাকেন।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা-২ সুয়ে মেন জো বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, করোনা সংক্রমণের কারণে বছরের প্রথম কয়েক মাস বিবাহ বিচ্ছেদের হার কম ছিল। কিন্তু লকডাউন শেষে বিচ্ছেদের হারে পরিবর্তন এসেছে। শুধু জুলাই মাসে এই অঞ্চলে ১৩৩ জন বিচ্ছেদের আবেদন করেছেন। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা-৩ এ এস এম সফিউল আজম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, লকডাউনে ও করোনা সংক্রমণ শুরুর প্রথমদিকে বিচ্ছেদের হার কম থাকলেও গত তিন মাসে বিচ্ছেদের হার আবার বাড়তে শুরু করেছে।
উত্তর সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা-১ মো. জুলকার নায়ন বলেন, করোনা সংক্রমণের এই সময়ে যারা বিচ্ছেদের আবেদন করছেন তারা নিষ্পত্তির জন্য আসছেন না। আর নির্দিষ্ট সময়ের পর এবং তিনবার নোটিস দেওয়ার পর যখন কোনো পক্ষই আসেন না তখন তালাক স্বয়ংক্রিয়ভাবেই কার্যকর হয়ে যায়।