মঞ্চনাটক এবং যাত্রায় প্রম্পটার একটি চরিত্র। প্রম্পটারের কাজ হচ্ছে মঞ্চের আড়াল থেকে অভিনেতা-অভিনেত্রীকে ডায়ালগ ধরিয়ে দেওয়া। প্রম্পটার কখনো দর্শকের সামনে আসেন না। আসাটা নিষিদ্ধও বটে। মূল মঞ্চে ঝলমলে আলোর নিচে অভিনেতা-অভিনেত্রী অভিনয় করেন। দর্শকরা আড়ালের প্রম্পটারদের কখনো দেখেনই না। কিন্তু ২৪ জানুয়ারি আমরা দুই প্রম্পটারকে দেখলাম অভিনেতার চরিত্রে অভিনয় করতে। একজন শিমুল বিশ্বাস, অপরজন মারুফ কামাল খান। প্রথমজন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী। দ্বিতীয়জন চেয়ারপারসনের প্রেসসচিব। যে নাটকে এই দুই প্রম্পটার মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন সে নাটকটি দেখেননি এমন মানুষ দেশে আছেন কি! একজন দর্শক হিসেবে টেলিভিশন স্ক্রিনে নাটকটি আমিও চোখের পলক না ফেলে দেখেছি। সত্যি বলতে কি, নাটকের শেষ পরিণতি আমাকে একটুও খুশি করেনি। মর্মাহত হয়েছি, বিরক্তও হয়েছি। মনে হচ্ছিল মঞ্চে পচা ডিম ছুড়ে মারি।
২৪ তারিখ বেলা ১টা নাগাদ খবর পাই বিএনপি চেয়ারপারসনের ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো মালয়েশিয়ায় মারা গেছেন। কোকোর আকস্মিক এই অকাল মৃত্যু সংবাদে খারাপ লাগাটাই স্বাভাবিক। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই জানতে পারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সহমর্মিতা জানাতে খালেদা জিয়ার গুলশানের কার্যালয়ে যাবেন। বিস্মিত হইনি। এটাই তো স্বাভাবিক প্রত্যাশা। হাজার বছরের বঙ্গীয় সংস্কৃতিতে এটাই তো স্বাভাবিক সৌজন্যবোধ। বাঙালির চিরায়ত সংস্কৃতির এই আচরণ শেখ হাসিনাকে যারা চেনেন তাদের কাছে নতুন কিছু নয়। শোকসন্তপ্ত পরিবারকে সমবেদনা জানাতে তিনি প্রায়শই সশরীরে উপস্থিত হন মৃত ব্যক্তির বাড়িতে। অসুস্থ ব্যক্তিদের দেখতে ছুটে যান হাসপাতালে। মৃত বা অসুস্থ ব্যক্তিরা সব সময় শেখ হাসিনার দলেরও নন। বেগম খালেদা জিয়া রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তার সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ। হোক প্রতিপক্ষ, তাই বলে অশ্রদ্ধা তো করা যায় না। শেখ হাসিনা এই সৌজন্যবোধের পরিচয় সব সময়ই দিয়ে থাকেন। সামাজিক শিষ্টাচারের জ্ঞানও তার সহজাত। পারিবারিক ক্ষেত্রে পাওয়া। তা ছাড়া মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা দেওয়ার মতো ভিনডিকটিভ মানসিকতার পরিচয় কখনো তিনি দেননি। তাই কোনো কোনো সহকর্মীর আপত্তি সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি কোকোর মৃত্যুতে তার জন্মদাত্রী মা খালেদা জিয়াকে সহমর্মিতা জানাতে যান। এই আচরণে আমি শত সহস্র বছরের সামাজিক সংস্কৃতির স্বাভাবিক প্রকাশকেই বড় করে দেখতে চাই। রাজনীতির কূটচাল কিংবা নোংরামি হিসেবে ভাবতেও চাই না। সবকিছুর ভিতরই রাজনীতির গন্ধ খোঁজা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়। আর সন্দেহপ্রবণতা তো একটি রোগ। তাই মানুষের সব আচরণকে সন্দেহের দৃষ্টিতে না দেখে কিছু কিছু আচরণকে স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ত হিসেবে মেনে নেওয়া মঙ্গল। কোকোর মৃত্যুতে মাতা খালেদাকে সহমর্মিতা জানাতে যাওয়ার ব্যাপারকে আমি তাই স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ত সামাজিক দায়িত্ব পালন মনে করি।
সন্ধ্যা ৮টা থেকে দেশের কোটি কোটি দর্শকের মতো আমিও টেলিভিশন সেটের স্ক্রিনে পলকহীন তাকিয়ে থাকি। মনের ভিতর এঁকে নিই বিষাদের এক চিত্রকল্প। যেমন অকাল প্রয়াত পুত্রশোকে মাতা মুহ্যমান, নির্বাক, দিশাহারা। দুই চোখ বেয়ে ঝরছে অঝোর অশ্রুধারা। মাঝে মাঝে বুকফাটা আর্তনাদে মূর্ছাও যাচ্ছেন। বাড়িভর্তি আত্দীয়-স্বজন, নেতা-নেত্রী, ছোট-বড় নানা বয়সী ঘনিষ্ঠজন। সবাই বিষণ্ন, অনেকের চোখ অশ্রুসিক্ত, লাল। বাড়িময় লোবানের অলৌকিক গন্ধ। শেখ হাসিনা বাড়ির দরজায় এসেছেন খবর পেয়ে মুুরবি্ব শ্রেণির কয়েকজন দ্রুত বেরিয়ে গিয়ে তাকে বাড়ির ভিতর নিয়ে এলেন। শেখ হাসিনা দাঁড়ালেন অশ্রুমতি মাতার শয্যাপাশে। শব্দহীন অনেকটা সময় পার হয়ে গেল। মাঝে মাঝে পুত্রহারা মায়ের বিলাপ ঘরের নিঃশব্দতা ভেঙে দিচ্ছে। কী করবেন শেখ হাসিনা! কী বলে সান্ত্বনা জানাবেন! তবে কি শোকার্ত মাতার মাথায় সহমর্মিতার হাত বুলিয়ে দেবেন। শেখ হাসিনা যেমন ভাষা খুঁজে পাচ্ছেন না, খালেদারও কিছু শোনার মতো অবস্থা নেই। শেখ হাসিনা দু-একজন বর্ষীয়ান আত্দীয় এবং সিনিয়র বিএনপি নেতাদের সঙ্গে কথা বললেন অত্যন্ত নিচু স্বরে। জানতে চাইলেন পরিবারের করণীয় সম্পর্কে। জানালেন প্রয়োজনে তার সহযোগিতার কথা। তারপর এসএসএফের অনুরোধে শেষবারের মতো শোকার্ত খালেদার দিকে খানিক তাকিয়ে থেকে শেখ হাসিনা ধীর পায়ে বেরিয়ে গেলেন। তাকে গাড়ি অবধি পৌঁছে দিতে মুরবি্ব শ্রেণির নেতারা সঙ্গে গেলেন।
আমার চিত্রকল্পটি কাল্পনিক ছিল তা স্বীকার করব না। যুগে যুগে, কালে কালে এ রকমটিই হয়ে এসেছে। এ রকম হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। পক্ষান্তরে যা ঘটল তা কল্পনাতীত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিরাপত্তার ঝুঁকি নিয়ে বাড়ির ফটকে অপেক্ষা করে নীরবে ফিরে গেলেন। বাড়ির ভিতরে অবস্থানরত বিএনপির সিনিয়র নেতারা কি প্রধানমন্ত্রীকে সম্মান দেখাতে বেরিয়ে আসতে পারতেন না। শোকে মুহ্যমান এবং ইনজেকশনের কড়া ওষুধে ঘুম পাড়িয়ে রাখা খালেদা জিয়ার শয্যাপাশে তাকে কি একটু দাঁড়ানোর সুযোগ করে দিতে পারতেন না। শেখ হাসিনা ফিরে যাওয়ার পর কোনো সিনিয়র নেতা দলের মুখপাত্র হয়ে অপেক্ষমাণ মিডিয়াকর্মীদের সামনে দায়িত্ব নিয়ে দুটো কথা বলতে পারতেন না! প্রম্পটারদেরই মূল অভিনেতা হয়ে মঞ্চে দাঁড়াতে হলো। তবে কি! কত প্রশ্ন। কত জিজ্ঞাসা। উত্তর নাই।
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।