তিন মাসের এই সময় বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ‘উইন্ডো অব অপরচুনিটি’, যার ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে শুল্ক স্থায়ীভাবে প্রত্যাহারের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালানোর সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি এই সাময়িক স্থগিতাদেশ রপ্তানিকারকদের জন্য কিছুটা স্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়াবে, কারণ এতে অর্ডার বাতিল বা স্থগিত হওয়ার আশঙ্কা আপাতত কমবে। সর্বোপরি ব্যাবসায়িক ও সরকারি উভয় পর্যায়ে কৌশলগত প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সময় পাওয়া গেল, যা ভবিষ্যতের সম্ভাব্য শুল্ক চাপ মোকাবেলায় সহায়ক হতে পারে।
তবে ট্রাম্প প্রশাসন উচ্চ শুল্ক স্থগিত করলেও সর্বনিম্ন ১০ শতাংশ বহাল রেখেছে, যার তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়তে পারে।
প্রথমত, মূল্য প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশি পণ্য কিছুটা পিছিয়ে পড়বে, কারণ ১০ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের ফলে মার্কিন বাজারে বাংলাদেশের পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। ফলে আমদানিকারকরা হয়ত তুলনামূলকভাবে কম দামের উৎস যেমন ভিয়েতনামের দিকে ঝুঁকতে পারেন। দ্বিতীয়ত, অর্ডার কমে যাওয়ার সম্ভাবনাও তৈরি হয়, নতুন ক্রেতারা চুক্তি করতে আগ্রহ হারাতে পারেন, আর পুরোনো ক্রেতারা অর্ডার হ্রাস করতে পারেন। ফলে রপ্তানি আয় কমে যাবে, যা দেশের কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে, বিশেষ করে শ্রমনির্ভর খাতে।
এই প্রেক্ষাপটে কয়েকটি করণীয় আছে, যা নীতি প্রণয়ন ও ব্যাবসায়িক কৌশলে গুরুত্ব দেওয়া দরকার। প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্রে কৌশলগত লবিং জোরদার করতে হবে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ মিশন, দূতাবাস এবং প্রবাসী ব্যবসায়ীদের একত্রিত করে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালাতে হবে। দ্বিতীয়ত, সাধারণ গার্মেন্টসের তুলনায় উচ্চ মূল্যের, টেকনিক্যাল বা নন-কটন পণ্যে রপ্তানি বাড়ানোর মাধ্যমে মূল্য সংযোজন বাড়াতে হবে। তৃতীয়ত, শুধু মার্কিন বাজারে নির্ভর না থেকে ইউরোপ, কানাডা, পূর্ব এশিয়ার মতো বিকল্প বাজার চিহ্নিত করে বাজার বৈচিত্র্য নিশ্চিত করতে হবে।
চতুর্থত, ক্ষতিগ্রস্ত রপ্তানিকারকদের জন্য স্বল্পমেয়াদি স্থানীয় প্রণোদনা প্যাকেজ বিবেচনা করা যেতে পারে, যাতে তারা ক্ষতি সামাল দিতে পারে এবং কর্মসংস্থান টিকিয়ে রাখতে পারে।
এই তিন মাসের সময়কালে বাংলাদেশের প্রস্তুতির ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয়কে অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন। একই সঙ্গে স্থানীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠানগুলো বিশেষ করে কাস্টমস, মান নিয়ন্ত্রণ, বাজার প্রবেশ এবং পণ্য নিরাপত্তা—এসব ক্ষেত্রে সক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে। এই প্রস্তুতিমূলক রূপরেখা না থাকলে সাময়িক শুল্ক স্থগিতাদেশের সুফল ভবিষ্যতে কাজে লাগানো কঠিন হয়ে পড়বে।
সরকারের উচিত একটি উচ্চ পর্যায়ের টাস্কফোর্স গঠন করা, যেখানে সরকারি সংস্থা, রপ্তানিকারক, শিল্প সংগঠন, নীতি-গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং কূটনৈতিক প্রতিনিধিরা একত্রে কাজ করতে পারবেন।
এই টাস্কফোর্সের কাজ হবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আসন্ন বাণিজ্য আলোচনা ও নীতিনির্ধারণের জন্য একটি বাস্তবসম্মত ও সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা তৈরি ও বাস্তবায়ন করা।
লেখক : অর্থনীতির অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং নির্বাহী পরিচালক, সানেম