বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের ডাকা অবরোধ কর্মসূচির আজ ৭৫তম দিন চলছে। এ ধরনের একটি চরম আন্দোলন কর্মসূচি এত দীর্ঘদিন অব্যাহত রাখার নজির আমাদের দেশে তো নেই-ই, পৃথিবীর অন্য কোনো গণতান্ত্রিক দেশেও নেই। শুরুটা যেমন ছিল, এমন কি সপ্তাহ দুই-তিনেক আগেও কর্মসূচি যতটা চলমান ছিল, বর্তমানে তা নেই। বলা চলে অনেকটাই বিবর্ণ হয়ে পড়েছে ২০ দলীয় জোটের টানা অবরোধ আন্দোলন। সপ্তাহে পাঁচ কর্মদিবসেই হরতাল রাজধানীতে তেমন কোনো ছাপ শুরু থেকেই ফেলতে পারেনি। ঢাকাসহ বড় বড় কয়েকটি শহর-নগরে পুলিশ-র্যাব-বিজিবি পাহারায় যানবাহন চালিয়েছে সরকার। তবে প্রায় জেলা শহরে প্রথমদিকে হরতাল একেবারে অসফল হয়েছে বলা যাবে না। কিন্তু তাও কতদিন এই কষ্ট সহ্য করতে পারে মানুষ? জীবন-জীবিকার তাগিদে মানুষ একসময় বেপরোয়া হয়ে যায়। বলা যায়, ২০ দলীয় জোট হরতাল ডাকে কিন্তু কোথাও এখন তার তেমন সাড়া নেই। এমন কি যারা বিএনপি-জামায়াতের সমর্থক-শুভানুধ্যায়ী তারাও আর মানতে চাইছেন না এসব টানা কর্মসূচি। আন্দোলনের যৌক্তিকতার প্রতি সমর্থনের কারণে দল-বিশেষের সমর্থক-অনুরাগী না হয়েও যারা নৈতিক সমর্থন দিয়েছিলেন কর্মসূচির প্রতি, তারাও এখন বলছেন সফলতার আলো দেখার জন্য আর কত অপেক্ষা? আর কত কষ্ট ভোগ? লীগ সরকার তার প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বীকে থামানোর জন্য নানা কৌশল অবলম্বন করেছে, রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোকে ব্যবহার করেছে, কোথাও কোথাও তারা আইনবহির্ভূত নিষ্ঠুর আচরণও করেছে; বিরোধী দলের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার, মামলা-মোকদ্দমায় জড়ানো চলছে সমানতালে- সবই ঠিক। কিন্তু এসব কারণেই বিরোধী দলের আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়েছে এটা বলা যাবে না। মূলত জনগণের, এমনকি ২০ দলীয় জোটের, বিশেষ করে বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীদের অনাগ্রহের কারণেই পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে।
গভীর পর্যবেক্ষণে যেটা মনে হয়, ২০ দলীয় জোট, বিশেষ করে বিএনপি তার রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের কৌশল প্রণয়নে ও প্রয়োগে যোগ্যতা দক্ষতা, রাজনৈতিক পরিপক্বতা ও প্রজ্ঞার পরিচয় দিতে পারেনি। সঠিক রাজনীতি নির্ধারণ এবং তা বাস্তবায়নের লক্ষ্যভেদী কৌশল নির্ণয়ের জন্য একটি রাজনৈতিক দলে প্রয়োজন দক্ষ পোড়খাওয়া কিছু কেরিয়ার রাজনীতিবিদের। রাজনীতি তো আত্দমর্যাদাসম্পন্ন স্বাধীনচেতা রাজনীতিবিদের কাজ; স্তাবক, তাঁবেদার, পা-চাটা সেবাদাসের কাজ নয়। ফুট-ফরমায়েশ খাটা চাকর-বাকর মার্কা লোকদের কাজ তো নয়-ই। তার ওপর ভিন্ন মতাদর্শের এজেন্টরা দলে ঢুকে যাওয়া তো আরও বিপদের। বাংলাদেশের বর্তমান প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে ত্যাগী, দক্ষ, অভিজ্ঞ কেরিয়ার রাজনীতিবিদ নেই বললে সত্যের অপলাপ হবে। বরং দুই দলেই এমন অনেকে আছেন যাদের ভূমিকা ও অবদান এদেশের সব গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং সুমহান মুক্তিযুদ্ধে অত্যন্ত গৌরবোজ্জ্বল। এমনকি তৃণমূল পর্যায়েও এখনো অনেক প্রবীণ রাজনীতিবিদ আছেন, কেন্দ্র যাদের খবরই রাখে না। কিন্তু দলের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে এদের স্থান কোথায়? কর্মসূচি গ্রহণ-প্রণয়নে এদের মতামতের কি কোনো গুরুত্ব আছে? হ্যাঁ, এরা আছেন; রাখা হয়েছে দলের অলঙ্কার হিসেবে, 'সাইনবোর্ড' হিসেবে- ওই তো 'ওনারা আছেন' কথাটা বলার জন্য। লক্ষণীয় হচ্ছে, দল যখন খুব বিপর্যয়ে পড়ে যায়, তখন আবার এই প্রবীণ প্রাজ্ঞজনদেরই শরণাপন্ন হতে হয়, কাজ ফুরালেই আবার শেষ। দুই দলেই এমন কিছু রাজনীতিবিদের নাম উল্লেখ করে বলা যায় কিন্তু বলাটা সঙ্গত হবে না বিধায় বলছি না। সচেতন মানুষ কিন্তু জানেন। বিএনপিতে বিষয়টা অধিকতর পীড়াদায়ক। দেশি-বিদেশি বড় বড় ডিগ্রি আর রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা যে এক নয় তা বুঝতে চান না তাদের 'নীতি-নির্ধারকরা'। সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব অর্থবিত্তের এবং ব্যক্তি ও পরিবার বিশেষের প্রতি অন্ধ আনুগত্যের। স্তুতি, তোষামোদ, কদমবুচিপন্থা যোগ্যতা। বিএনপির নেতৃত্ব কাঠামো কেমন হবে তা নির্ধারণের এখতিয়ার একান্তই বিএনপির নীতি-নির্ধারকদের, অন্য কারও নয়। বিএনপির অনুরাগী সমালোচকরা মনে করেন, এই দলের শর্ষেতেই ভূত আছে। এখানে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত ব্যক্তি যেমন আছেন, অকর্মণ্য লোক, আছেন (হাঁটতে-চলতেও পারেন না), আবার এমন লোকও আছেন রাজনীতিতে বাপের নাম জিজ্ঞাসা করলে যিনি দুলাভাইয়ের নাম বলবেন। এরা দলের রাজনৈতিক লাইন নির্ধারণ এবং কর্মকৌশল প্রণয়ন করলে তা সঠিক হবে ভাবা বোকামি মনে করেন অনেকে। দলে আরও অনেক সংকটই দৃশ্যমান। এমতাবস্থায় দলের গৃহীত লাগাতার অবরোধ কর্মসূচি এবং পরবর্তীকালে প্রতি সপ্তাহে পাঁচ দিন করে হরতাল অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত এখন প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।
কেউ কেউ বলেন, এমনকি সরকার পক্ষের বিদেশি ডিগ্রিধারী বুদ্ধিজীবীরাও বলেন এ বছর ৫ জানুয়ারি অবরুদ্ধ অবস্থায় সাংবাদিকদের জিজ্ঞাসাতেই নাকি বেগম খালেদা জিয়া রাগে ও ক্রোধে লাগাতার অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। এই বক্তব্য যথার্থ বলে মনে হয় না। বরং বলা চলে এই কর্মসূচি বেগম খালেদা জিয়ার সুচিন্তিত ও পূর্বপরিকল্পিত। বর্তমান সরকার, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পর্কে তার পর্যবেক্ষণ থেকে তিনি নিশ্চিত ছিলেন, তাকে ৫ জানুয়ারির কর্মসূচি পালন করতে দেওয়া হবে না। গত বছরের ২৯ ডিসেম্বরের মতোই একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হবে। তাই তিনিও তার দল ও জোটের করণীয় ঠিক করে রেখেছিলেন। তবে দল ও জোটের যে শক্তির ওপর ভরসা করে তিনি এমন একটি কঠোর ও চ্যালেঞ্জিং কর্মসূচি ঘোষণা করেন, সেই শক্তির এসেসমেন্টটি সঠিক হয়নি। বোঝা গেছে, তিনি নির্ভর করেছিলেন তার জোট সঙ্গী জামায়াতে ইসলামীর ওপর। জামায়াত তাকে সম্পূর্ণ বিট্রে না করলেও একটা কৌশলী খেলা খেলেছে বলে মনে হয়। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে তাদের দলের দণ্ডিত নেতাদের ব্যাপারে এবং তাদের দলের অন্যদের বিচার প্রক্রিয়ার ব্যাপারে জামায়াত বিএনপির স্পষ্ট ভূমিকা দাবি করে থাকতে পারে। আন্দোলন সফল হলে, বিএনপি সরকার গঠনে সক্ষম হলে মন্ত্রিসভায় জামায়াতের অন্তর্ভুক্তিকরণ, একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া চালু রাখা না রাখার ব্যাপারে বিএনপির আগাম সিদ্ধান্তও তারা দাবি করে থাকতে পারে। কিন্তু বিষয়টা এতই জটিল ও স্পর্শকাতর যে, এই ব্যাপারে হ্যাঁ বা না কোনো স্থির সিদ্ধান্তে আসা বেগম খালেদা জিয়ার জন্য এখন আর এত সহজ নয়। বলা হয়ে থাকে, বিএনপির লাইফ ব্লাড এখনো প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তি। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বিএনপি প্রতিষ্ঠার পর মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী তাকে নিঃশর্ত ও অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছিলেন। তিনি তার গোটা দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিটাই তুলে দিয়েছিলেন শহীদ জিয়ার হাতে। এমনকি দলের নির্বাচনী প্রতীক ধানের শীষও। এটা ছিল ন্যাপের প্রতীক। বিএনপি গঠনের আগে তিনি প্রথম ১৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে ১৯ দফা বাস্তবায়ন কমিটি ও পরে বিচারপতি আবদুস সাত্তারের নেতৃত্বে জাগদল গঠনে উৎসাহ দিয়েছিলেন। কেএম ওবায়দুর রহমান ও ফেরদৌস কোরেশীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের একটি অংশও এতে যোগ দেয়। যোগ দেয় জাসদের কিছু তরুণ। ১৯ দফা বাস্তবায়ন কমিটি ও জাগদলে প্রগতিশীল গণতন্ত্রীরাই ছিলেন সংখ্যাধিক। পরে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে যে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট গঠিত হয় তার কম্পোনেন্ট ছিল-১. জাগদল, ২. ন্যাপ (ভাসানী) ৩. ইউনাইটেড পিপলস পার্টি-ইউপিপি, ৪. রশরাজমণ্ডলের নেতৃত্বাধীন তফসিলী ফেডারেশন, ৫. মাওলানা মতিনের নেতৃত্বাধীন লেবার পার্টি এবং ৬. শাহ আজিজুর রহমানের নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগ। ক্ষয়িষ্ণু মুসলিম লীগের এখানে ওখানে কিছু বয়স্ক লোক ছাড়া কোনো শক্তি ছিল না। ফ্রন্টের মূল শক্তি ছিল প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক ধারার ব্যক্তি ও শক্তি। বিএনপির জন্মের পরও এই শক্তিই ছিল দলের প্রাণ। সারা দেশে এরাই বিএনপিকে সংগঠিত করেছে। যে যত কথাই বলুন না কেন, সারা দেশে এখনো বিএনপি সাংগঠনিকভাবে দাঁড়িয়ে আছে সাবেক ন্যাপ, ইউপিপি, আওয়ামী লীগ, জাসদের লোকজনের ওপর ভিত্তি করেই। ৩৬-৩৭ বছর সময়ে বহু নতুনের সমারোহ ঘটেছে দলে। তবে নির্দ্বিধায় বলা চলে এরা সবাই প্রগতিমনা, গণতন্ত্রী, আধুনিক ও বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ। ছাত্রদল এক সময় দেশের বৃহত্তম ছাত্র সংগঠন ছিল, ডাকসুর নেতৃত্ব পর্যন্ত দিয়েছে। তারা কেউ জামায়াত-শিবির থেকে আগত নয়। যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল শহীদ জিয়ার দেওয়া নাম। সবই গঠিত হয়েছিল গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল ঘরানার লোকদের সমন্বয়ে। সেই সংগঠনগুলো আগের অবস্থানে নেই সত্য, যেটুকু আছে তা এখনো মৌলবাদী প্রতিক্রিয়াশীলদের একেবারে দখলে চলে গেছে বলা যাবে না। তাই জামায়াতে ইসলামীর এজেন্ডা বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিলে বিএনপিতে একটা বড়সড় ভাঙন অনিবার্য। আর ভাঙনের দায়িত্ব যদি কেউ নিতে না চান তা হলে দলটি হয়ে যাবে মুসলিম লীগের মতো একটি 'মরহুম' দল। আবার অন্যদিকে সংখ্যায়-শক্তিতে কমজোর হলেও বিএনপিতে, কেন খালেদা জিয়ার ওপর এবং দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ওপর চরম প্রতিক্রিয়াশীল, দক্ষিণপন্থি মৌলবাদী শক্তি জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের ভাবধারার অনুসারীদের প্রভাব নাকি এখন দিগন্ত প্লাবিত। বেগম জিয়া এবং তারেক জিয়া নাকি মনে করেন, এই শক্তির সমর্থন ও সক্রিয় সহযোগিতা ছাড়া বিএনপি ক্ষমতায় যেতে পারবে না। ভোট এবং আন্দোলনে নাকি অপরিহার্য। এই কারণে তাদের এজেন্ডা একেবারে অগ্রাহ্যও করতে পারছে না বেগম খালেদা জিয়া। কী ভুল চিন্তা! পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, বিএনপি আজ না হোক কাল বুঝবে, জামায়াত তাদের জন্য এসেট নয়, লায়াবিলিটি। দলটির কাছ থেকে বিএনপি যে সমর্থন-সুবিধা পায়, তাদের বাদ দিলে সমর্থন পাবে তার চেয়ে বেশি। বহু প্রগতিশীল, গণতন্ত্রী জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে মাখামাখির কারণে বিএনপিকে সমর্থন করতে পারছে না, যারা সমর্থন করত, ভোট দিত তারাও তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করেছে। যে জামায়াতের ওপর বেগম জিয়ার এত ভরসা, তারা ভরসার মর্যাদা দিচ্ছে না বলেই মনে হচ্ছে।
২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি লীগ সরকার বিএনপির সঙ্গে, তাদের নেত্রীর সঙ্গে যে আচরণ করেছে তা শোভন ছিল না, গণতান্ত্রিক শিষ্টাচারবহির্ভূত, এমনকি দেশের সংবিধানবহির্ভূতও ছিল। সে কারণে ঘোষিত কর্মসূচি আওয়ামী মহল ছাড়া অন্যদের সমর্থনও পেয়েছিল। এই ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ করাতে একটা রাজনৈতিক দলের যেমন কৃতিত্ব থাকে, তার চেয়েও কৃতিত্বপূর্ণ কাজ আন্দোলনের ফসল ঘরে তুলে সঠিক সময়ে তার সমাপ্তি ঘোষণা করা। আন্দোলনে কোথায় থামতে হবে তা না জানলে বিপদ হয়। সব অর্জন নষ্ট হয়। বিপদের পর বিপদ বাড়ে। বিএনপি একটি বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক দল। আওয়ামী লীগাররা যতই বলুক, এটি কোনো জঙ্গি সংগঠন নয়, কর্মী-সমর্থকদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যও তেমন নয়। মৌলবাদী চিন্তার অনুসারীও বলা যাবে না তাদের। ধার্মিক আর ধর্মভীরু হলেই কেউ মৌলবাদী জঙ্গি হয় না। প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে তো সবাই জানেন যে, তিনি ধর্মপরায়ণা। তাহাজ্জতের নামাজও আদায় করেন। কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে দিবসের কাজ শুরু করেন। তাই বলে কি তিনি মৌলবাদী? নিশ্চয়ই না। কাজেই বিএনপির লোকজনের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ সঠিক নয়। বিএনপি একটি বিপ্লবী দলও নয় যে, লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত সশস্ত্র লড়াই চালিয়ে যাবে। সভা-সমাবেশ, মিটিং-মিছিল, বিক্ষোভ, হরতাল, অবরোধ এমনকি অসহযোগ পর্যন্ত গণতান্ত্রিক ও নিয়মতান্ত্রিক পন্থার আন্দোলনেই বিএনপির কর্মীরা অভ্যস্ত। বোমাবাজি, সশস্ত্র সংঘাত বিএনপি কর্মীদের কাছে গ্রহণযোগ্য কর্মসূচি হওয়ার কথা নয়। অবরোধে কিন্তু পেট্রলবোমাবাজি হয়েছে, নিরীহ মানুষ দগ্ধ হয়ে মারা গেছে, অনেকে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে। বিএনপি বলছে এসব তারা করেনি। তাহলে করল কারা? বিএনপি জোটের কর্মসূচির ছাতার তলেই তো হয়েছে এসব। স্বস্তির বিষয় হচ্ছে, এসব জঘন্য অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড অনেকটাই কমেছে। মানুষ চায় এসব সম্পূর্ণ বন্ধ হোক। এটা শুধু সরকারের চাওয়া নয়। বিএনপির উচিত ছিল, একটা সময় তাদের ঘোষিত কর্মসূচির সমাপ্তি ঘোষণা করা। সরকারের ওপর প্রচণ্ড একটা চাপ বিরোধী দল সৃষ্টি করতে পেরেছিল। প্রায় দেড় মাস রাজধানী ঢাকা সারা দেশ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্নই ছিল। সত্যি বলতে কি, রাষ্ট্র পরিচালনার প্রায় সব ক্ষেত্রেই সরকার প্রায় ব্যর্থ হয়েছিল। কিন্তু এই যে, কোথায় থামতে হবে জানল না বিএনপি। 'ম্যাডাম চালিয়ে যান, ম্যাডাম চালিয়ে যান' রাজনীতিবিদদের পরামর্শ না নিয়ে কর্মচারী-তোষামোদকারীদের এমন কুমন্ত্রণাই বোধহয় কাল হয়েছে বেগম খালেদা জিয়ার, বিএনপির। সময় মতো থামলেন না। দুটো সুবর্ণ সুযোগ এসেছিল। এক. এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে কর্মসূচি প্রত্যাহার না হোক, স্থগিত করা যেত, দুই. সরকারের কাছে সংলাপ-সমঝোতার জন্য বিদেশি বন্ধুদের বিশেষ করে জাতিসংঘ মহাসচিবের চিঠিকে এবং দেশের ব্যবসায়ীমহলের অনুরোধ রক্ষা করে কর্মসূচি থেকে সরে আসা যেত। বেগম জিয়া যে অনর্থক সাংবাদিক সম্মেলন করলেন, তাকে খুবই অর্থপূর্ণ করে তুলতে পারতেন ওইদিন সাময়িকভাবে কর্মসূচি প্রত্যাহার করে এবং সংলাপের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে আনুষ্ঠানিক লিখিত প্রস্তাব দিয়ে। তাতে সরকার ব্যাকফুটে চলে যেত।
এখন বিএনপি ব্যাকফুটে। সরকার উল্টো বেশি করে চড়াও হচ্ছে বিএনপির ওপর। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চলমান অভিযান আরও জোরদার করা হয়েছে আন্দোলন শিথিল হয়ে যাওয়ার সুযোগে। জানা গেছে, গত বছরের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ও পরে নাশকতার ঘটনায় দায়ের করা বিভিন্ন মামলা চাঙ্গা করা হচ্ছে। মামলাগুলো সন্ত্রাসবিরোধী আইনে বিচার করতে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। পাশাপাশি বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন দলে থাকা দুর্নীতিসহ অন্য মামলাও চাঙ্গা করা হচ্ছে। জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ককে পুঁজি করে জঙ্গিবাদী তৎপরতায় ২০ দলীয় জোটকে দায়ী করতেও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে যাতে বহির্বিশ্বের কাছে দলটির ভাবমূর্তির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, মানুষ হত্যার দায়ে খালেদা জিয়াকে শাস্তি পেতে হবে। ইতিমধ্যে অবরোধ ও হরতালে মানুষ হত্যার দায়ে বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়েছে। তারেক রহমানের বিরুদ্ধেও একই ধরনের মামলা দায়ের করে মা ও ছেলেকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর চিন্তা-ভাবনাও সরকারের মধ্যে কাজ করছে বলে আভাস মিলছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে অন্য মামলার পাশাপাশি এই সংক্রান্ত মামলাও নাকি নিষ্পত্তি করে ফেলতে চায় সরকার। অভিযোগ প্রমাণিত হলে দুজনই নির্বাচনে অযোগ্য হয়ে যাবেন। বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি দুর্নীতি সংক্রান্ত বেগম জিয়াসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলায় হাইকোর্টের আদেশ দাখিলের জন্য আগামী ১৩ এপ্রিল দিন ধার্য করা হয়েছে। এছাড়া ডান্ডি ডায়িংয়ের ঋণখেলাপি মামলায় প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর ওয়ারিশ হিসেবে মা হিসেবে খালেদা জিয়াকে পক্ষভুক্ত করা হয়েছে। তারেক রহমানকেও দেশে ফেরত এনে বিচার করার চেষ্টা চলছে। অর্থাৎ বিএনপির সামনে আরও কঠিন দিন আসছে। আন্দোলনে সফল হলে পরিস্থিতি হতো অন্যরকম। সময়মতো থামলেও সম্মানজনক পরিণতি হতো। এখন তো আন্দোলন ব্যর্থতার মুখে। কোথায় অবরোধ? কোথায় হরতাল?
ব্যর্থতার গ্লানি কাটিয়ে বেগম খালেদা জিয়া কি পারবেন আবার ঘুরে দাঁড়াতে? তবে আর যাই করুন, নিজেরা কষ্ট না করে মানুষকে কষ্ট দেওয়ার কোনো পথ যেন না নেওয়া হয়। ততটুকুই নির্ধারণ করা উচিত যতটুকু শক্তিতে কুলোয়। যতটুকু দৌড়ানোর দম আছে দৌড়ের সীমা ততটুকুই নির্ধারণ করা উচিত। আমাদের মনে আছে, শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের আমলেও কিছু লোক 'কট্টরপন্থি' সেজে হঠকারী পদক্ষেপ নিতে চেয়েছিলেন। তা ঠেকিয়েছিলেন দলের তৎকালীন মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া। রক্ষা করেছিলেন বিএনপিকে, বলা যায় বিপর্যয়ের হাত থেকে বেগম জিয়াকেও। মান্নান ভূঁইয়াকে বলা হয়েছিল 'নরমপন্থি' 'আপোসকামী', এমনকি সরকারের দালাল। এরা মান্নান ভূঁইয়াকে বাদ দিয়ে খোন্দকার মোশাররফ বা সাকা চৌধুরীকে বিএনপির মহাসচিবও বানাতে চেয়েছিলেন। সাকা চৌধুরী গংয়ের তথাকথিত সেই কট্টরপন্থি গ্রুপের প্রমোটররা এখনো বেগম জিয়ার আশপাশেই আছেন, এমনকি 'আলোকিত' করে রেখেছেন তার গুলশান কার্যালয়; কিন্তু নেই একজন আবদুল মান্নান ভূঁইয়া। বেগম জিয়ার শুভানুধ্যায়ীদের ভয়টা এখানেই।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
ই-মেইল : [email protected]