বহুদিন পর পুরনো একটি বিষয় দিয়ে আজকের প্রসঙ্গটি শুরু করতে চাই। গত সরকারের আলোচিত-সমালোচিত যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন এবং সেতু বিভাগের সচিব মোশাররফের সঙ্গে আমাদের প্রায়ই খটমট লেগে যেত। বিশেষ করে পদ্মা সেতু নিয়ে মন্ত্রী এবং সচিব যা বলতেন তা সংসদীয় কমিটির কোনো সদস্যই মেনে নিতে পারতেন না। কমিটির সদস্যদের মধ্যে আমি, ওমর ফারুক চৌধুরী ও অপু উকিল ছিলাম সবচেয়ে বেশি ভোকাল। সদস্যদের বেশির ভাগ আপত্তি এবং প্রশ্ন ছিল আবেগতাড়িত। অন্যদিকে মন্ত্রী-সচিবের উত্তর ছিল অনেকটা বাস্তবতার নিরিখে কাঠখোট্টা প্রকৃতির। ফলে কমিটির মিটিংগুলোয় প্রায়ই অনাহূত পরিস্থিতির উদ্ভব হতো যা কি না পর দিন সব দৈনিক পত্রিকার শিরোনাম হিসেবে প্রকাশিত হয়ে এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করত।
মন্ত্রী ও সচিবের অহংবোধ ছিল তাদের টেকনিক্যাল জ্ঞান, সদিচ্ছা এবং অমানুষিক পরিশ্রমের কারণে। তারা সকাল ৭টা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করতেন অতি সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে পদ্মা সেতু তৈরি করে ইতিহাসে নাম লেখানোর মানসে। কাজেই সংসদীয় কমিটির কিছু আবেগনির্ভর প্রশ্নে তারা প্রায়ই ধৈর্য হারিয়ে ফেলতেন এবং ক্ষেত্রবিশেষ রেগেও যেতেন। এ অবস্থায় মন্ত্রী-সচিব মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন সংসদীয় কমিটির লোকজনকে চীন দেশের বড় বড় সেতুর নির্মাণ কৌশল, ব্যয় এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্পর্কে বাস্তব জ্ঞান ও ধারণা প্রদান করানোর জন্য। আমরা সবাই চীন গিয়েছিলাম এবং অভূতপূর্ব এক বর্ণাঢ্য অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে দেশে ফিরেছিলাম। এর পর থেকে আমরা সম্মিলিতভাবে কাজ করার জন্য উদ্যমী হওয়ার আগেই মন্ত্রী ও সচিবের কপালে আগুন ধরে যায়। সে এক লম্বা কাহিনী এবং ভিন্ন প্রসঙ্গ। আজ আমি ওসব না বলে আজকের শিরোনামের সঙ্গে সম্পর্কিত চীন ভ্রমণের একটি প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বিষয়বস্তুর গভীরে চলে যাব।
আমরা যখন চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে অবস্থান করছিলাম তখন আমাদের ভ্রমণের আয়োজনকারীরা একদিন বিকালে আমাদের নিয়ে গেলেন বিখ্যাত নিষিদ্ধ নগরীতে। ইংরেজিতে যাকে বলা হয় ফরবিডেন সিটি। এটি ছিল মিং সম্রাটদের সরকারি বাসভবন। ১৩৬৮ সালে চেঙ্গিস খান প্রতিষ্ঠিত ইউয়ান সাম্রাজ্যের পতন হলে মিং সম্রাট জু ইউয়ান ঝাং তার রাজধানী নাংজিং থেকে বর্তমান বেইজিংয়ে স্থানান্তর করার মানসে একটি রাজকীয় প্রাসাদ নির্মাণের হুকুম দেন। যেদিন তিনি নতুন প্রাসাদে অভিষিক্ত হলেন সেদিন তিনি দুটো যুগান্তকারী কাজ করলেন। প্রথমটি ছিল সিংহাসনের ওপর তার একটি অমিয় বাণী খোদাই করা এবং দ্বিতীয়টি ছিল তার পরবর্তী বংশধর বিশেষ করে সিংহাসনের উত্তরাধিকারীদের জন্য একটি রাজকীয় ফরমান জারি করা যা কি না হুয়াং মিং ঝু উন বা সিংহাসনের আরোহীদের জন্য নির্দেশাবলি হিসেবে ইতিহাসে অমর হয়ে আছে।
সম্মানিত পাঠক হয়তো প্রশ্ন করতে পারেন, ফরবিডেন সিটির প্রসঙ্গ টানতে গিয়ে কেন আমি সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন এবং তৎকালীন সেতু বিভাগের সচিব মোশাররফের প্রসঙ্গ আনলাম? আমি মূলত কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্যই তাদের নাম এ লেখার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করলাম। তারা অতি চমৎকারভাবে আমাদের চীন ভ্রমণের প্রতিটি বিষয় এমনভাবে সাজিয়েছিলেন যাতে আমাদের পক্ষে কোনো কিছু না শিখে গাফেল অবস্থায় ফিরে আসা সম্ভবপর ছিল না। আমরা যখন নিষিদ্ধ নগরীতে ঢুকলাম তখন আমাদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হলো অদ্ভুত এক যন্ত্র। যন্ত্রটি আমরা পকেটে ঢোকালাম এবং যন্ত্রের সঙ্গে সংযুক্ত হেডফোনটি কানে লাগালাম। এরপর আমরা প্রাসাদের মধ্যে হাঁটতে লাগলাম আর অমনি যন্ত্রটি থেকে বিশুদ্ধ বাংলায় আমাদের কানের পর্দায় বাজতে থাকল প্রাসাদের প্রতিটি ইঞ্চি জায়গার কৃষ্টি-কালচার, ইতিহাস-ঐতিহ্য, নানারকম ট্র্যাজেডি, কমেডি এবং রূপকথার বর্ণালি সব কাহিনী। সে কাহিনী এত লম্বা এবং ব্যাপক যে একজন পর্যটক একনাগাড়ে সাত-আট দিন যদি প্রাসাদের ইঞ্চি ইঞ্চি জায়গায় পা ফেলে এগোতে থাকেন তবুও শেষ হবে না। অমন ইতিহাস চীন দেশের শাহি হেরেমে হাঁটতে হাঁটতে বাংলায় শোনার সৌভাগ্য কজনের হয়েছে তা জানি না তবে আমার হৃদয়ে সেই স্মৃতি আজও জাগরূক হয়ে আছে অমলিন এক উজ্জ্বল দলিল হিসেবে।
আমরা যখন সিংহাসনের সামনে এলাম তখন কানে বেজে উঠল- অনুগ্রহ করে একটু সতর্ক হোন এবং মনোযোগ দিয়ে মহান একটি রাজকীয় ফরমান শুনুন। সিংহাসনের ওপরে খোদাই করা শব্দগুলোর অর্থ বলার আগে আপনার অবশ্যই জানা উচিত মহান সম্রাট ঝু ইউয়ান ঝাং সম্পর্কে যিনি তাবৎ দুনিয়ার কাছে হংউ সম্রাট হিসেবে সবার কাছে সমাদৃত। তিনিই চীন দেশের পাঁচ হাজার বছরের রাজনৈতিক ইতিহাসের অন্যতম মহানায়ক এবং মিং সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। তার বংশধররা টানা ২৭৬ বছর মহাচীনকে শাসন করেছিল প্রবল বিক্রম এবং গৌরব নিয়ে। সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে তিনি প্রথম যেদিন এ সিংহাসনে আসীন হলেন সেদিন তার বংশের সবাইকে ডেকে সমস্বরে খোদাই করা লেখাগুলো পড়তে বললেন। এরপর তিনি সবার হাতে তুলে দিলেন তার রাজকীয় ফরমান। সবশেষে বললেন, তোমরা যদি আমার নির্দেশগুলো মেনে চল এবং এ সিংহাসনের অধিকারী যদি সব সময় খোদাই করা বক্তব্যটি স্মরণ করে তবে কোনো দিন মিং বংশ রাজ্যহারা হবে না।
এখন বলছি সম্রাট ঝু ইউয়ান ঝাংয়ের অমিয় বাণীটি সম্পর্কে। সম্রাট বলেন, শাসকের সবকিছু হতে হবে স্বচ্ছ। তার কথা চিন্তা, চেতনা, ব্যক্তিগত জীবন এবং রাজনীতির ভাষা হবে স্বচ্ছ, বোধগম্য এবং বিশ্বাসযোগ্য। শাসকের জীবনের সবচেয়ে বড় অভিশাপ তখনই নেমে আসবে যখন জনগণ তাকে শ্রদ্ধা করবে না, বিশ্বাস করবে না এবং কায়মনোবাক্যে তার মৃত্যু কামনা করবে। পরিস্থিতি যখন এমন হয় তখন শাসক কোনো অবস্থাতেই জনগণের ভাষা বুঝতে পারেন না। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা এবং চীন সম্রাটের অমিয় বাণী নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা না করে শিরোনাম প্রসঙ্গে কিছু কথা বলে আজকের লেখার ইতি টানব। ভেলকিবাজির রাজনীতির কবলে পড়লে সব রাজপুরুষই কলঙ্কিত হতে বাধ্য। যদি প্রশ্ন করা হয় ভেলকিবাজি বলতে কী বোঝায় এবং একজন শাসক তার শাশ্বত নীতি বাদ দিয়ে কোন ভেলকিবাজির রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন? বাংলা অভিধানে ভেলকি শব্দের অর্থে বলা হয়েছে- ধোঁকা এবং বাজি অর্থ জাদুর খেলা। কাজেই ভেলকিবাজি বলতে বোঝায় এমন এক জাদুময় ধোঁকার খেলা যার সঙ্গে সত্যের লেশমাত্র থাকে না। স্বাভাবিক জাদুতে দর্শক আনন্দ লাভ করে এবং ক্ষেত্রবিশেষ প্রতারিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু ভেলকিবাজিতে ক্ষতির পরিমাণ সীমাহীন। লোকজন বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং ভেলকিবাজির নায়ক-নায়িকার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়ে আক্রমণ চালায়। দ্বিতীয় প্রশ্ন রাজপুরুষ তো প্রবল ক্ষমতাধর। তাকে কেন ভেলকিবাজির আশ্রয় নিতে হয়। উত্তর খুবই সহজ। রাজা প্রথমে নিতান্ত কৌতুকবশে ভেলকিবাজি শুরু করেন। এসব করতে করতে তিনি কখন যে মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়েন তা তিনি মৃত্যুর পূর্বক্ষণেও বুঝতে পারেন না। রাজার ভেলকিবাজির কারণে যারা লাভবান হন তারা তাকে চরমভাবে উত্তেজিত করতে থাকেন ওসব করার জন্য। অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্ত নয় অথচ রাজার শুভাকাঙ্ক্ষীরা ওসব কথা রাজাকে বলার স্পর্ধা হারিয়ে ফেলেন।
এবার রাজনীতির ভেলকিবাজি নিয়ে কিছু বলা দরকার। রাজা যখন তার কিছু গোপন কর্ম নিয়ে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন কিংবা তার ব্যক্তিগত দুর্নীতি, লোভ-লালসা-কামনা-বাসনার কিছু বিষয় নিয়ে অন্তজ্ববালায় জ্বলতে থাকেন তখন হঠাৎ করেই তার মধ্যে অতি ধার্মিক, অতিবীর কিংবা অতিমানব হওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। ফেরাউন যখন অনেকটা প্রতারণা করে নিজের বোনকে বিয়ে করল এবং সামাজিকভাবে প্রচণ্ড সমালোচনার শিকার হলো ঠিক তখনই তার মনে কেবল অতিমানব নয়, খোদা হওয়ার উদগ্র বাসনা চেপে বসল। একইভাবে মুহাম্মদ বিন তুঘলক ওরফে সম্রাট জুনাখান যখন বুঝতে পারলেন জনগণ এবং আমাত্যবর্গ বুঝে ফেলেছেন যে তিনি তার পিতা গিয়াসউদ্দিন তুঘলককে হত্যা করেছেন তখন তিনি রীতিমতো পাগলামো শুরু করলেন। উদ্দেশ্য একটাই- সবাই তাকে ভয় পাক।
রাজা তার প্রতিপক্ষের ওপর অন্যায়, অবিচার এবং জুলুম করতে গিয়ে যখন পশুত্বকে হার মানায় তখন তার পক্ষে ভেলকিবাজির রাজনীতি ছাড়া অন্য কোনো উপায় থাকে না। ব্যক্তিগত যৌনজীবন, আর্থিক কেলেঙ্কারি, জ্ঞানবুদ্ধির সীমাবদ্ধতা এবং অতি দুর্বল স্নায়ু অর্থাৎ সাহস-শক্তি নিম্নমানের হওয়ার কারণে রাজা রাজনীতির মাঠে দম্ভ করে বেড়ান। তার কাপুরুষতা তাকে প্ররোচিত করে অত্যাচারী হওয়ার জন্য। তার নির্বুদ্ধিতা তাকে প্রলুব্ধ করে প্রকাশ্যে অনবরত মিথ্যা বলার জন্য। তার অল্পজ্ঞান তাকে উত্তেজিত করে দম্ভ করার জন্য। তার নির্লজ্জতা তাকে উপদেশ দেয় প্রতিনিয়ত মিথ্যা অভিনয় করার জন্য। অন্যদিকে তার নিয়তি তাকে প্রবল বেগে টানতে থাকে শেষ পরিণতির দিকে।
ইতিহাসে হাজারো ভেলকিবাজ রাজা-মহারাজার নাম রয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্যি পৃথিবীতে বীর পুরুষের তুলনায় কাপুরুষের সংখ্যা বহুগুণ বেশি। সাধকের তুলনায় ভণ্ডের সংখ্যা সীমাহীন আর মানুষের চেয়ে অমানুষ তো অগণিত! সভ্যতার চেয়ে অসভ্যতার ইতিহাস বড়, শান্তির চেয়ে অশান্তির ব্যাপ্তি ব্যাপক; সুখের চেয়ে অসুখের স্থায়িত্ব দীর্ঘ। সমাজে মানুষ হওয়ার প্রতিযোগীদের তুলনায় অমানুষ হওয়ার প্রতিযোগীর লাইন দিন দিন দীর্ঘতর হচ্ছে। যদি প্রশ্ন করেন- কারণ কী? উত্তর একটাই- কেয়ামত হতে হবে না?
লেখক : কলামিস্ট