দেশে শাখাপ্রশাখাসহ নদনদীর সংখ্যা সহস্রাধিক। এর মধ্যে ছোটবড় মিলিয়ে বর্তমানে প্রবহমান নদীর সংখ্যা প্রায় ৩৫০টি। এসব নদনদীর মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরে অন্তত ২৪ হাজার কিলোমিটার জলপথ গঠিত হয়েছে। তবে এর মধ্যে নৌপরিবহনের উপযোগী নৌপথের দৈর্ঘ্য ৫ হাজার ৯৬৮ কিলোমিটার; যা শুষ্ক মৌসুমে হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় প্রায় ৩ হাজার ৮৬৫ কিলোমিটারে।
দেশে দীর্ঘ জলপথ থাকায় যেমন স্বল্পমূল্যে মালামাল পরিবহনের সুযোগ হচ্ছে, তেমনি বিপুল জলরাশি থেকে প্রতিনিয়ত পর্যাপ্ত মাছ আহরণেরও সুযোগ হচ্ছে। অথচ বন্যাপ্রবণতার কারণে নদীকে মানুষ অভিশাপ হিসেবেও দেখছে। সেই বন্যাই দেশের ফসলি জমির মাটিকে আরও উর্বর ও শক্তিশালী করে তুলছে। এতে নদীর পাড়ের জমিগুলো চাষের উপযোগী হয়ে ফলন বাড়ছে বহু গুণ। শুধু বর্ষাকালেই নয়, শুষ্ক মৌসুমেও নদীর অবদান অবিস্মরণীয়। নদীর পানিই তখন সেচের জন্য একমাত্র ভরসা হয়ে ওঠে। শুধু সেচ আর পলি বিলিয়েই নদী ক্ষান্ত হয়নি; নদী আমাদের প্রকৃতিকে মরুকরণপ্রক্রিয়া থেকেও রক্ষা করছে বিভিন্নভাবে।
এত সব সুবিধা ভোগ করার পরও মানুষ নদীর প্রতি যেভাবে বৈরী আচরণ করে চলেছে, তা অত্যন্ত দুঃখজনক। একদিকে নদী আমাদের দিচ্ছে উর্বর মাটি, সেচের সুবিধা, যাতায়াতের পথ, জীবিকার উৎস। আর অন্যদিকে সেই নদীকেই ধ্বংসের পথে ঠেলে দিচ্ছি আমরা। প্রথমত নদীতে প্রতিনিয়ত ফেলা হচ্ছে কলকারখানার বিষাক্ত বর্জ্য। যে বর্জ্য নদীর জলজ প্রাণীর জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠছে এবং জীববৈচিত্র্যে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। পাশাপাশি পরিবেশ বিপর্যয়েরও অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। দ্বিতীয়ত বিভিন্ন প্রকল্পের অজুহাতে নদী ভরাট করে বানানো হচ্ছে বাঁধ, রাস্তা ও বসতি। এতে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়ে আয়তন ও গভীরতা হ্রাস পাচ্ছে। এসব ছাড়াও সবচেয়ে ঘৃণ্য দিক হলো, সরাসরি নদীর বুকে মলমূত্র ত্যাগ করা। বিশেষ করে নৌযাত্রার সময় যাত্রীদের একটি বড় অংশ নৌযানে থাকা শৌচাগারে মলমূত্র ত্যাগ করছে, যা সরাসরি নদীতেই পড়ছে। এর ফলে শুধু নদীর পানিই দূষিত হচ্ছে না, জনস্বাস্থ্যও হুমকির মুখে পড়ছে। বিশেষ করে সমাজের দরিদ্র জনগোষ্ঠী, যারা নৌযানে যাতায়াত করে কিংবা নদীর আশপাশে বসবাস করে, তারা বেশি বিপাকে পড়ছে। তাদের পক্ষে বোতলজাত বিশুদ্ধ পানি কেনা সব সময় সম্ভব হয় না বলে নিরুপায় হয়ে নদীর দূষিত পানিই পান করছে। এতে একধরনের চক্র সৃষ্টি হচ্ছে। নিজেরাই নদীদূষণ করছে, আবার সেই দূষিত পানি নিজের শরীরে ঢুকিয়ে নিচ্ছে। তবে নৌযানের যাত্রীরা নদীদূষণের জন্য সরাসরি দায়ী নন। কারণ অধিকাংশ নৌযানে পয়োনিষ্কাশনের কোনো সুব্যবস্থা নেই। ফলে এসব শৌচাগারে ত্যাগ করা মলমূত্র সরাসরি নদীর পানিতে মিশে যাচ্ছে, যা নদী ও পরিবেশদূষণের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। যখন সমগ্র বিশ্ব পরিবেশ রক্ষায় সচেতন ও সোচ্চার হয়ে উঠেছে, তখন আমাদের নদীগুলোর এই করুণচিত্র বিবেকবান প্রতিটি মানুষকে নাড়া দিচ্ছে।
এ ছাড়াও লক্ষণীয়, নদী বা খালতীরবর্তী অঞ্চলের মানুষ নদীর কিনারেই বাঁশ-কাঠ কিংবা চটের বেড়া দিয়ে কাঁচা পায়খানা নির্মাণ করছে এবং প্রতিনিয়ত মলমূত্র ত্যাগ করছে, যা নদীদূষণের অন্যতম কারণ। আবার মৃত পশুর সৎকারও হচ্ছে নদনদীতেই। এর ফলে দূষণের মাত্রা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে, স্যুয়ারেজের সংযোগ এবং নদীতে পলিথিন বিসর্জন। নদীতে বর্জ্য, পলিথিন ও অন্যান্য দূষিত পদার্থ ফেলার কারণে শুধু নদীর পানি অস্বাস্থ্যকর ও দুর্গন্ধযুক্ত হচ্ছে না, নদীর জীববৈচিত্র্যেও মারাত্মক পরিবর্তন ঘটছে। পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা হ্রাস পাওয়ায় জলজ উদ্ভিদ ধ্বংস হচ্ছে এবং দেশীয় প্রজাতির মাছ ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হচ্ছে। এই ভয়াবহ পরিস্থিতির সবচেয়ে বড় ও জ্বলন্ত উদাহরণ রাজধানীর পাশে বুড়িগঙ্গা নদীর করুণ পরিণতি। কলকারখানার অপরিশোধিত তরল বর্জ্য, বাসাবাড়ির পয়োনিষ্কাশন, স্যুয়ারেজ এবং প্লাস্টিকজাত আবর্জনার কারণে নদীর পানি ঘন কালো রং ধারণ করেছে; তীব্র দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। নদীর বুক চিরে চলা নৌযানে যাতায়াতের সময় শ্বাস নেওয়া কষ্টকর হয়ে ওঠে। এমনকি নদীতীরবর্তী সড়ক দিয়ে হেঁটেও চলা কঠিন হয়ে পড়েছে। দূষণ ও দুর্গন্ধের এ অবস্থা আশপাশের জনজীবনকে করছে বিপর্যস্ত।
এই দূষণ এখন আর শুধু বুড়িগঙ্গা নদীতেই সীমাবদ্ধ নেই; তা পেরিয়ে গেছে ধলেশ্বরী হয়ে মেঘনার কাছাকাছি পর্যন্ত। নৌপথে চলাচলকারী যাত্রীরা এই পরিবর্তন টের পাচ্ছেন।
অন্যদিকে প্লাস্টিকদূষণের ভয়াবহ প্রভাবে এখন নদীর মাছের পেটে মাইক্রোপ্লাস্টিক কণার উপস্থিতি লক্ষ করা যাচ্ছে। এই কণাগুলো সাধারণত ৫ মিলিমিটারের চেয়েও ছোট কিন্তু ক্ষতির দিক থেকে ভয়ানক। অত্যন্ত ক্ষুদ্র আকারের হলেও, মাইক্রোপ্লাস্টিক অনায়াসেই মাছের শরীরে প্রবেশ করে মারাত্মক বিষক্রিয়া ঘটাচ্ছে। এই দূষণ পরোক্ষভাবে মানুষের খাদ্যচক্রেও প্রবেশ করছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য ভয়াবহ হুমকি। এসব বিষয় গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় নিয়ে এখনই সচেতন হতে হবে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক