নতুন বছর মানে শুধু একটা ক্যালেন্ডার বদল করা নয়, এটি এক বিপ্লবী অনুভূতির নাম। পৃথিবীর নানা প্রান্তে এই দিনটিকে ঘিরে গড়ে উঠেছে বিচিত্র কিছু রীতি, যার প্রতিটিই যেন একেকটা সংস্কৃতির স্পন্দন। তাই নতুর বছরের উৎসব কেবল একটি দিনের উৎসব ও অনুষ্ঠান হিসেবে শেষ নয়। এটি একটি প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির অনুভূতি। যেখানে মানুষ আশা, ভালোবাসা ও নতুন কিছু সংকল্প নিয়ে অনাগত ভবিষ্যৎকে গড়ার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হবে। অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নেব, যেটুকু ভুল ছিল শুধরে নেব, না পাওয়ার কষ্টটুকু ভুলে যাব, জীবন, পরিবার, সমাজ ও দেশকে সুন্দর করে সাজানোর জন্য আরম্ভ করব নতুন পথচলা। বিদায়ি বছরের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির স্মৃতি পেছনে ফেলে নতুন বছরে নতুন আশায় এগিয়ে যেতে হবে। নতুন ভাবনা, নতুন স্বপ্ন নিয়ে পুরোনো বছরের সংশয়, সংকট, উদ্বেগ ও ব্যর্থতা মুছে ফেলতে হবে। বয়ে আনতে হবে আনন্দ ও সফলতার ঝলমলে প্রভাত। দিন যায়, মাস যায়, পার হয় বছর। এভাবে একদিন শেষ হয়ে যায় জীবন। হেলায় খেলায় কত সময় অতিক্রম করি, এর সঠিক মূল্যটা অনেকেই হিসাব করি না। মহানবী (সা.) বলেন, ‘দুটি নিয়ামত এমন আছে, যে দুটোতে অধিকাংশ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। তা হচ্ছে, সুস্থতা আর অবসর (সহিহ বুখারি-৫৯৭০)।’
ইতোমধ্যেই একটা বছর আমাদের জীবনের ঘড়ি থেকে বিদায় নিয়েছে। অনেক ভাগ্যবানের জীবনে সফলতা বয়ে এনেছে এ বছর। আবার কারও জীবনে ঘটেছে অনাকাক্সিক্ষত ছন্দপতন। নতুন বছর শুরু হয়েছে, এই বছর শুভ হোক। সফল হোক। সুন্দর হোক। সবার জীবনে বয়ে আনুক সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি। এমনই শুভকামনার মাধ্যমে মাসবরণ ও বর্ষবরণ করা ইসলামের নীতি, মহানবী (সা.)-এর আদর্শ। রসুলুল্লাহ (সা.) নতুন চাঁদ দেখে বলতেন, ‘হে আল্লাহ! আমাদের জন্য চাঁদটিকে কল্যাণময়, ইমানদীপ্ত এবং নিরাপত্তা, শান্তি ও ইসলামের বাহন হিসেবে আনয়ন করুন। আমার প্রভু এবং তুমি চাঁদের প্রভু মহান আল্লাহ (তিরমিজি শরিফ-৩৪৫১)।’
ইসলাম-পূর্ব মদিনায় নববর্ষ ও বসন্ত উৎসব পালন করা হতো। উকাজ মেলা নামে একটি বিনোদনমূলক উৎসব পালন করার রীতিও প্রচলিত ছিল। মূলত এসব উৎসব ছিল পারস্য সংস্কৃতি। এতে ছিল না মানবতা ও নৈতিকতার কোনো ছোঁয়া। তাই মানবতার নবী মুহাম্মদ (সা.) দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা দেন, ‘প্রত্যেক জাতির আনন্দ উৎসব আছে। আর আমাদের আনন্দ উৎসব হলো, এই দুই ঈদ (সহিহ বুখারি-৯৫২)।’
ইতিহাসবিদদের তথ্যমতে, আনুমানিক দেড় শ বছর আগে থেকে এই বর্ষবরণপ্রথা চলে আসছে। তখন এই উৎসব শুধু পশ্চিমা দেশেই পালন হতো। তারা এই উৎসব তাদের ধর্মীয় রীতি মেনেই পালন করতে আরম্ভ করে। তাই কোনো মুসলমান অপর কোনো ধর্মের ধর্মীয় রীতি অনুসরণ করতে পারে না। কিন্তু বর্তমানে এই রীতি সমগ্র বিশ্বে মুসলিম-অমুসলিম সবার মধ্যে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। বর্ষবরণের এই উৎসবে কখনো কখনো আতশবাজি, ফানুস ওড়ানো এবং অশ্লীলতা হয়ে থাকে। যা সরকারিভাবেও নিষিদ্ধ। দেশের আইন অমান্য করে অনেকেই ওই সব ন্যক্কারজনক কাজে লিপ্ত হয়। নতুন বছরকে স্বাগত জানানো উপলক্ষে এভাবে সীমা লঙ্ঘন এবং আতশবাজি শুভলক্ষণ নয়। জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি হয় এমন কাজ কারও কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার কথা নয়। তাই যারা এমন কর্মে লিপ্ত তাদের শুভবুদ্ধির উদয় হওয়ার কামনা করার বিকল্প নেই। নতুন বছরটা আমরা উদ্যাপন করতে পারি তওবার মাধ্যমে। বিগত বছরের ভুলত্রুটি ও অন্যায় থেকে ক্ষমা চাওয়ার দারুণ সুযোগ এই নতুন বছর। নতুন বছরে বিগত বছরে ভালোমন্দ এবং সফলতা-ব্যর্থতার হিসাব মিলিয়ে নিতে পারি। পারি নিজেকে বদলে ফেলার সংকল্প গ্রহণ করতে। নতুন বছরে মুসলমান নিজেকে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে হবে। ইমান ও আমলের জন্য নিজেকে নতুন করে গঠন করতে হবে। নামাজ, রোজা ও যাবতীয় ইবাদত যে জ্ঞান ও আস্থা নিয়ে করতে হয় তা নতুনভাবে ত্বরান্বিত করতে হবে।
আনন্দ উৎসব মানুষের প্রাণের চাহিদা। সুস্থ শরীর ও উৎফুল্ল মানসিকতার সহায়ক। তাই ইসলাম মানুষের জন্য সর্বজনীন উৎসবের ব্যবস্থা করেছে। বছরে দুটি ঈদ, সাপ্তাহিক জুমা, দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের জামাত এবং সামর্থ্যবানদের জন্য হজ আদায় করা ইসলামের অন্যতম উৎসব। তবে উৎসবের নামে নিরাপত্তাঝুঁকি এবং আতঙ্ক সৃষ্টি করাকে ইসলাম সমর্থন করে না। সমর্থন করে না অপচয়, জুয়া, লটারি, মাদক, নেশা এবং মানবতা পরিপন্থি ও সমাজবিরোধী কোনো অপকর্মেরও। তাই ইসলামি আদর্শের আলোকে পুরোনো বছরের তুলনায় নতুন বছরকে আরও প্রশান্তিময় করার সুদৃঢ় প্রত্যয় গ্রহণ করতে হবে।
লেখক : গবেষক, ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার বসুন্ধরা, ঢাকা