প্রতিটি সফলতার গল্পের পিছনে একটি স্বপ্ন ভাঙার চিৎকার থাকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেই চিৎকার বাতাসে মিলিয়ে যায। ক্রান্তিকাল পার করে মানুষ আবার সফলতার সূর্য দেখেন। তখন সবাই সফলতার কাহিনী শুনতে চান, শোনেনও। কিন্তু স্বপ্ন ভাঙার সেই চিৎকার ক'জনার কর্ণপাত হয়! কতদূর শোনা যায় সেই শব্দ ! ভাঙা-গড়ার ক্রান্তিকালে যে কেউ চান প্রিয়জন, প্রিয় মানুষটি তার হাত ধরে বলুক- 'চিন্তা করো না, তুমি পারবে ঘুরে দাঁড়াতে। আমি তোমার পাশে আছি!' এই একটু উৎসাহ, একটু অনুপ্রেরণা দুর্বলকে সবল হতে আর নতুন করে স্বপ্ন দেখতে সাহস জোগায়। পাশে থাকার প্রত্যয়টুকু জীবন পথে দ্রুত মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে অনেকের। এমনই একজন সিরাজগঞ্জের মৃনাল চৌধুরী।
১৯৯০ সালে আমিরাতে এসে শারজায় পাকিস্তানি মালিকাধীন একটি পোশাক কারখানায় চাকুরী নেন মৃনাল। কাজ করেন টানা ১২ বছর। বেতন ভালই ছিলো। কিন্তু প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বেশি বেতনে তাকে আর রাখতে চাননি মালিক। ছেড়ে দিতে হয় চাকুরী। একদিকে চাকুরী নেই, অন্যদিকে দেশের ভিটেমাটিটুকু গ্রাস করে নেয় সর্বখেকো নদী। দিশেহারা মৃনালের হাত ধরে স্ত্রী চুমকি চৌধুরী তখন বলেছিলেন- 'বেশি বেতন যদি না পাও চাকুরী করবে কেন ? নতুন কিছু করতে পারো। আমি আছি তোমার পাশে।' সেই অনুপ্রেরণায় আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে মৃনাল। বৌয়ের গয়না বিক্রি করে আজমানের নতুন সানাইয়া এলাকায় দোতলা ভবনে দাঁড় করেন হুমায়ত আল মাতরশি রেডিমেট ওয়ার্কশপ গার্মেন্টস ট্রেডিং নামে ছোট খাটো একটি পোষাক কারখানা।
২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠান চালু করলেও লোকবল ও যাবতীয় কাগজ পত্র তৈরী করতে তার লেগে যায় আরো একটি বছর। ২০০৫ সালে ২৪ জন কর্মী নিয়ে পুরোদমে শুরু হয় কারখানার কাজ। শ্রমিক কর্মচারীদের সবাই বাংলাদেশি। প্রথম দিকে ঠিকঠাক ব্যবসা চললেও বছর পেরুতেই পার্টনারদের বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হন বলেন জানান মৃনাল। এ সময় ফের সাহস দিলেন চুমকি চৌধুরী। অর্থ সংকটে সিদ্ধান্ত হলো কিছু মেশিন বিক্রি করে দেয়ার। কথা মতো কাজ। মেশিন বিক্রির টাকায় ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠানের নীচ তলায় পুনরায় চালু করেন পোষাক সামগ্রীর দোকান। এবার আর পিঁছু তাকাতে হয়নি আজমান প্রবাসী এই দম্পতির। ধীরে ধীরে যাতায়াত বাড়ে বাংলাদেশি ক্রেতাদের। মৃনাল জানান, 'আমাদের বেশির ভাগ কাস্টমার বাংলাদেশি। দু-চার জন আছে ইন্ডিয়ান ও পাকিস্তানি।'
চুমকি চৌধুরী জানালেন, পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা ও মূলধনের অভাবে পোষাক সামগ্রী সরাসরি আনতে পারেন না ঢাকা থেকে। বাংলাদেশি পাইকারী বিক্রেতারা ঢাকা থেকে পাঞ্জাবী, লুঙ্গী, গামছাসহ বেশ কিছু পোষাক আইটেম নিয়ে এসে দোকানে দিয়ে যান। ইন্ডিয়ানরাও সাপ্লাই দেন। কিছু কিছু পণ্য আমিরাতের বাঙ্গালী বাজার থেকে কিনে দোকানে তোলেন তারা। আবার বেশির ভাগ টি-শার্ট আসে চায়না ও ইন্ডিয়া থেকে। বাংলাদেশ থেকেও আসে, তবে খুব অল্প পরিমাণে। সেগুলো ডিউটি পোষাক হিসেবে ব্যবহার করেন এখানকার শ্রমিকরা।
ট্রেইলারিং ওয়ার্কশপের কথা জানিয়ে মৃনাল বলেন, 'কিছু মেশিন বিক্রি করে দেয়ায় লোকবল কমে গেছে। বর্তমানে ৯ জন শ্রমিক আছে। বাংলাদেশি ভিসা বন্ধ থাকায় নতুন শ্রমিকও আনতে পারছি না। ভিসা চালু হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করছি। কারণ, বাংলাদেশি কর্মী-শ্রমিকরা দক্ষ ও আন্তরিক। যদি ভিসা চালু না হয় তবে মজবুরিতে পড়ে হয়তো ভিনদেশি লোক আনতে হবে।'
উল্লেখ্য, সিরাজগঞ্জের মৃনাল চৌধুরী নাটোরের চুমকীকে বিয়ে করেন ১৯৯৬ সালে। বিয়ের এক বছর ছয় মাস পর চুমকিকে আমিরাতের নিয়ে যান মৃনাল। দুই ছেলে মেয়ের মধ্যে বড় মেয়ে পূজা মিনাকশী আল-আমিন ইংলিশ স্কুল এণ্ড কলেজের একাদশ শ্রেণিতে ও ছেলে প্রিন্স চৌধুরী একই প্রতিষ্ঠানে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ছে।
বিডি-প্রতিদিন/২৩ জুন ২০১৫/ এস আহমেদ