ভাষা শহীদ এবং শহীদ মুক্তিযোদ্ধাসহ জীবিত সকল মুক্তিযোদ্ধাকে উৎসর্গ করে বিশেষ একটি অনুষ্ঠান হলো নিউইয়র্ক সিটির জ্যাকসন হাইটসে। গত সোমবার ১১ (ফেব্রুয়ারি) মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস-ঐতিহ্য বিশেষ করে চেতনার মধ্যে মিশে থাকার এই অনুষ্ঠান করলো ‘সেন্টার ফর বাংলা ক্রিয়েটিভ ওয়ার্কস’ তথা ‘শিল্পাঙ্গন’।
একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দু’বছর যাবত বাংলা সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক চর্চার সকল ধারায় নিয়মিত শিক্ষা, সাধনা ও প্রসারে নিয়োজিত রয়েছে শিল্পাঙ্গন। নতুন প্রজন্মকে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিতে উদ্বুদ্ধ ও শিক্ষিত করে তোলার পাশাপাশি অন্য সংস্কৃতির সঙ্গে আদান প্রদানও শিল্পাঙ্গনের অন্যতম লক্ষ্য বলে সংগঠনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে সুপরিকল্পিত, সুসংগঠিত ও উন্নত পেশাদার পরিবেশনা সকলকেই মুগ্ধ করেছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক ছিলো, অনুষ্ঠানে ছিল না কোন তথাকথিত বিরক্তিকর বক্তৃতা, এক পরিবেশনা থেকে অন্য পরিবেশনায় যাওয়ার মাঝে বিলম্ব, এবং সর্বোপরি সঠিক সময়ে অনুষ্ঠান শুরু করতে পারা ছিল দর্শকদের জন্য এক পরম পাওয়া।
শুরুতেই শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হয় বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা যুদ্ধসহ সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের, যাদের দেশপ্রেম, সাহসিকতা ও প্রগতিশীলতায় আজ বাঙালিরা বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তবে অনুষ্ঠানে উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান জানানোর একটি পর্ব থাকলে পুরো আয়োজনের মেজাজ আরো পুরিপূর্ণ হতো বলে অনেকে অভিমত পোষণ করেছেন অনেকেই।
সম্প্রতি প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা ও সঙ্গীতজ্ঞ আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলসহ সকল জীবিত ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধার উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠানটি উৎসর্গ করা হয় এবং তাদের সম্মানে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। সংগঠনের সভাপতি আমর আশরাফ উপস্থিত সুধীবৃন্দকে সংক্ষেপে স্বাগত জানান এবং সংগঠনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ব্যাখ্যা করেন। এ সময় তার পাশে ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার আকতার কামাল-নির্বাহী পরিচালক, মো: নজরুল ইসলাম-সাংস্কৃতিক বিষয়ক পরিচালক এবং ফালাহ আহামেদ- অর্থ পরিচালক। সংক্ষিপ্ত এ পর্বের উপস্থাপনা করেন বেবী আজিজ।
অনুষ্ঠানের প্রথম পরিবেশনা ছিল সঙ্গীতালেখ্য “বাংলাদেশের হৃদয় হতে”। কবিতায় ও গানে উপস্থাপন করা হয় মহান ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা যুদ্ধ, বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশের গৌরবময় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে।
মেধাবী রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী বিদিশা দেওয়ানজীর পরিকল্পনা ও পরিচালনায় একক, যুগল ও সমবেত কণ্ঠে গান পরিবেশন করেন মৌসুমী বড়ুয়া, সামিনা আশরাফ, ইশরাত আহমেদ পরশিয়া, মাহনাজ হাসান, ফারজানা সুলতানা শরমিন, শাহপার ইসলাম সিমি, ইশরাত কুমু, সোনিয়া হক, তাসফিয়া রুবাইয়াৎ কৈশি, সোনিয়া পান্না, দীপ্তি বড়ুয়া, সায়েম শাহরিয়ার অন্তু, মাহমুদ চৌধুরী, মোহাম্মদ শানু, আরিবা আহমেদ, সামায়রা মাহিবা, রাই সরকার, নুসায়বাহ কবির, আয়না মাহিবা ও লিয়ানা মাহবিন। আবৃত্তি করেন সাবিনা হাই উর্বি, শরফুজ্জামান মুকুল, মোহাম্মদ শানু ও মো: নজরুল ইসলাম। সঙ্গীত তত্বাবধানে ছিলেন সৌগত সরকার, কী বোর্ডে মো: রিপন, তবলায় পিনাক পানি গোস্বামী, এবং গীটারে মোহাম্মদ শানু ও আকাশ আহসান। গ্রন্থনায় ছিলেন মো: নজরুল ইসলাম।
এরপর ছিল নাটিকা “বাংলা মা”। ১৯৫২ সালে সালাম, রফিক, জব্বার, বরকতসহ আরো অনেক বীর বাঙালী বুকের রক্তে প্রতিষ্ঠিত করেছে মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা। তাদের পেছনে ছিল তাদের পরিবার, ছিল সারা দেশ। এ আত্মত্যাগ শুধু ক’জন শহীদেরই নয়, গোটা জাতির। বাংলা মায়ের কথা, শহীদের কথা, দামাল ছেলেদের কথা বলা হয়েছে নাটিকায়। ম. ম. জসীমের রচনা ও নির্দেশনায় “বাংলা মা” নাটিকায় অভিনয় করেছে জিনাতুন নাহার হেরা এবং নেপথ্যে কণ্ঠ দেন মো: নজরুল ইসলাম।
অসাধারণ অভিনয়ের পর আবারও গান পরিবেশিত হয়। ১৯৫২ সালে বাংলা মায়ের যেসব দামাল ছেলেরা ভাষার দাবিতে এবং জাতিসত্ত্বার দাবিতে মাঠে নেমেছিল তাঁদের বীরত্বগাঁথা সুরে সুরে পরিবেশন করেন সাইফুল্লাহ পারভেজ। গানের পর কবিতা। আমাদের অহংকারের একুশ, মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা, ও দেশের কথা পরিবেশিত হয় কবিতার ছন্দে। নিউইয়র্কের চারজন বিশিষ্ট আবৃত্তিশিল্পী পরিবেশন করেন, “অহংকারের পঙতিমালা”। শামসুর রাহমান, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ ও শহীদ কাদরীর কবিতা নিয়ে এক অসাধারণ আবেগময় ও উদ্দীপনামূলক পরিবেশনা করেন শরফুজ্জামান মুকুল, নীরা কাদরী, গোপন সাহা এবং ফারুক ফয়সাল।
অনুষ্ঠানের সর্বশেষ পর্বে ছিল বিশেষ নাটক “এখানে দরজা ছিল”। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নির্মিত আমর আশরাফের ভাবনা ও প্রয়োগে এবং নজরুল ইসলামের রচনা ও নির্দেশনায় এ নাটকে প্রাণবন্ত অভিনয় করেন দুই অভিনয় শিল্পী শিরীন বকুল এবং মিলা হোসেন। তাদের সঙ্গে অভিনয়ে আরো যোগ দেন রূপসজ্জাশিল্পী ও অভিনেতা ম. ম. জসীম, শওকত রিমন, মোহাম্মদ শানু, মোস্তফা মোর্শেদ মানু, লতিফ রহমান, মো: আওকাত খান, সামায়রা মাহিবা, সোনিয়া হক, ইশরাত কুমু ও নজরুল ইসলাম। নেপথ্য ব্যবস্থাপনায় ছিলেন ইকবাল ইসলাম, সোনিয়া হক, ইশরাত কুমু ও সালেহা।
বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ তাফসীর