ত্রুটিপূর্ণ নকশায় শহীদ মিনার নির্মাণ করে ভাষা শহীদদের অবমাননার অভিযোগ উঠেছে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর এম রোস্তম আলীর বিরুদ্ধে। একইসাথে শহীদ মিনার নির্মাণে নকশা জালিয়াতি ও দুর্নীতিরও অভিযোগ করেছেন শিক্ষক, কর্মকর্তা ও শিক্ষার্থীরা। তাদের অভিযোগ ও অনুরোধ উপেক্ষা করে শহীদ মিনারটি নির্মাণ শেষে উদ্বোধন অনুষ্ঠানে তোপের মুখে পড়েন উপাচার্য।
শনিবার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের দীর্ঘ প্রতীক্ষিত শহীদ মিনার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
তবে নির্মাণে অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করে রিজেন্ট বোর্ডের সিদ্ধান্তেই শহীদ মিনার নির্মিত হয়েছে বলে দাবী করেছেন উপাচার্য এম রোস্তম আলী।
প্রত্যক্ষদর্শী শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা জানান, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পাবিপ্রবির প্রগতিশীল শিক্ষক ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শহীদ মিনার নির্মাণের দাবি করে আসছে। গত বছর এপ্রিল মাসে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ২০২১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির আগেই ক্যাম্পাসে শহীদ মিনার নির্মাণের ঘোষণা দিয়ে আন্দোলনকারীদের শান্ত করেন উপাচার্য এম রোস্তম আলী।
পাবিপ্রবি জনসংযোগ দপ্তর জানায়, শহীদ মিনার নির্মাণের নকশার জন্য প্রতিযোগিতায় পাবিপ্রবির স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষার্থী মাহবুব হাসান ত্বহার নকশা নির্বাচিত হয়। সে ধারাবাহিকতায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান উন্নয়ন প্রকল্পের ৫৪ লক্ষ টাকা ব্যয়ে শহীদ মিনার নির্মাণের উদ্যোগ নেয় প্রশাসন। শনিবার তা উদ্বোধন করেছেন পাবনা সদর আসনের সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক প্রিন্স।
নকশাকারী মাহবুব হাসান ত্বহার বরাত দিয়ে পাবিপ্রবি জনসংযোগ দপ্তর জানায়, নবনির্মিত শহীদ মিনারের পাদদেশে থাকছে প্রশস্ত একটি কালোদেয়াল। যা ভেদ করে দন্ডায়মান শুভ শক্তির প্রতীক ৫২ ফুট উচ্চতার একটি পিলার। কয়েক ধাপ সিড়ি ও প্রশস্ত বেদীতে তা স্থাপিত।
নকশার মূলভাব বিশ্লেষণে ত্বহা জানান, কালো দেয়াল ভেদ করা শুভ শক্তির প্রতীক লম্বা পিলারটি জানান দেয় অশুভকে পরাভূত করে এগিয়ে গেছে জয়ের দিকে। তবে, নকশার ব্যাখ্যা ও নিমার্ণকে ত্রুটিপূর্ণ দাবি করে শুরু থেকেই প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ। তাদের দাবি এ নকশায় ভাষা শহীদদের চরম অবমাননা করা হয়েছে।
কেননা, মূল নকশায় শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণের বেদী রাখা হয়েছে অশুভ শক্তির প্রতীক কালো দেয়ালটির পাদদেশে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এম আব্দুল আলীম বলেন, শহীদ মিনার নির্মাণে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ভূমিকা বরাবরই রহস্যজনক। ছাত্রদের জমা দেওয়া প্রজেক্ট থেকে নকশা বাছাই করে সেই নকশা মূল্যায়নের জন্যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষকদের সমন্বয়ে গঠিত জুরি বোর্ডের সাহায্য নেওয়া হয়। সেই নকশায় শহীদ মিনার নির্মাণে সম্ভাব্য ব্যয় সরকারি বরাদ্দের দ্বিগুণ হলে তা চেয়ে মন্ত্রণালয়ে আবেদন পাঠানো হয়। মন্ত্রণালয় থেকে সেটা প্রত্যাখ্যাত হলে নতুন নকশা আহ্বান না করে খেয়াল খুশিমতো শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়েছে।
আব্দুল আলীম আরও বলেন, শহীদ মিনারের বিতর্কিত বিমূর্ত থিম ও অনিয়ম নিয়ে খোদ নকশা বাছাইকারী জুরি বোর্ডের সদস্যরাই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা শহীদদের এমন অবমূল্যায়ন কখনোই মেনে নেয়া যায় না। এটি রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয়ও বটে।
পাবিপ্রবির শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি ও বঙ্গবন্ধু পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আওয়াল কবীর জয় বলেন, শহীদ মিনার কেবল ইট-বালি-রড-সিমেন্টের দেয়াল কিংবা খুঁটি নয়, একুশের চেতনা এবং নান্দনিকতার সম্মিলনে তা এক তাৎপর্যপূর্ণ স্থাপনা। পাবিপ্রবির নবনির্মিত শহীদ মিনার নির্মাণের শুরু থেকেই থিম ও ডিজাইন নিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন তুললেও উপাচার্য তা কানে না তুলে তার নিজ গ্রামের এক ঠিকাদারকে দিয়ে তড়িঘড়ি করে নিম্নমানের কাজ করিয়ে প্রকল্পের অর্থ লুট করেছেন। এ কারণে শনিবার উদ্বোধনের সময় প্রধান অতিথির উপস্থিতিতেই হট্টগোলের সৃষ্টি হয়। থিম ও ডিজাইন সম্পর্কে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নানা প্রশ্নের উত্তরে উপাচার্য কেবল একটা কথাই বলার চেষ্টা করেছেন, তা হলো, 'রিজেন্ট বোর্ডের অনুমোদন নিয়ে সব কাজ করা হয়েছে।'
এ সময় শিক্ষক শিক্ষার্থীরা ফুল কোথায় দেয়া হবে জানতে চাইলে উপাচার্য মহোদয় দম্ভভরে জানালেন, সামনের কালো দেয়ালে পুষ্পস্তবক দেওয়া হবে।অথচ এই কালো দেয়াল অশুভ শক্তির প্রতীক।
পাবিপ্রবি শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ফরিদুল ইসলাম বাবু ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগের ইতিহাসে পরবর্তী প্রজন্মকে উজ্জীবিত করতেই শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়। অথচ পাবিপ্রবি অশুভ শক্তির প্রতি ফুল দিয়ে তাকে লালন করবে, এমন চিন্তার কথা ভাবতেই ঘৃণা হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, শিক্ষক শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আসা প্রধান অতিথি গোলাম ফারুক প্রিন্স এমপিও বিরক্তি প্রকাশ করেন। এসময় তিনি বলেন, এমন ঘটনা ঘটেছে আগে জানলে অনুষ্ঠানে কখনোই আসতাম না।
শহীদ মিনার নকশা নির্বাচনের জুরি বোর্ডের সদস্য পাবিপ্রবির স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষক ফেরদৌসী শিমু বলেন, জুরি বোর্ডের মতামত না নিয়েই মূল নকশা বিকৃত করে মাত্র ২০% রক্ষা করে শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়েছে। শুভ শক্তির মূল স্তম্ভের উচ্চতা ৫২ ফুট রাখার কথা থাকলেও ফান্ড নেই অজুহাতে তা করা হয়নি। জুরি বোর্ডের অনুমোদিত নকশাটি আদৌ বাস্তবায়ন হয়েছে তা সদস্যরা কেউ জানেন না।
শহীদ মিনার নির্মাণে অনিয়ম হয়নি নকশাতেও ত্রুটি নেই বলে দাবি করেছেন উপাচার্য এম রোস্তম আলী। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত সাংবাদিকদের তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের পর থেকেই অনৈতিক সুবিধা না দেয়ায় শিক্ষকদের একটি গ্রুপ আমার বিরোধিতা করে আসছেন। অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি করতেই তারা এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছেন।
বিডি প্রতিদিন/এ মজুমদার