দুনিয়াজুড়ে; দেশে ও বিদেশে সংকট সম্ভাবনার শেষ নেই। বাংলাদেশেও সমাজ ও রাজনীতির অনেক সমস্যা যেমন আছে, তেমনই রয়েছে আশাসঞ্চারী খবর। দুয়ারে কড়া নাড়ছে আবহমান বাংলার প্রিয় অতিথি পয়লা বৈশাখ- বাংলাদেশের মানুষের একমাত্র উৎসব, যা যথার্থই সর্বজনীন। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যা, বিপন্ন মানবতার আহাজারি, নারী-পুরুষ, শিশু ও বৃদ্ধের রক্তস্রোত বক্ষবিদীর্ণ করে চলেছে শান্তিকামী বিশ্বমানবের। মানবাত্মার কতখানি কষ্ট, ক্ষোভ ও আক্ষেপ জমা হলে দুনিয়ার মানুষ এক ডাকে, একসঙ্গে ফুঁসে উঠতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। গত সোমবার আর্ত-বিপন্ন গাজাবাসীর আহ্বানে বাংলাদেশসহ দুনিয়ার প্রায় সব দেশে গাজা ম্যাসাকারের প্রতিবাদে রাজপথে নেমে এসেছিল বিক্ষুব্ধ জনস্রোত। নারী-পুরুষ, ধর্মবর্ণ ও বয়সনির্বিশেষে সহস্র-লক্ষ মানুষের একটাই দাবি গণহত্যা বন্ধ কর, স্টপ জেনোসাইড ইন গাজা। কিন্তু বিশ্বমানবের হৃদয়নিসৃত সেই দাবি জায়নবাদী কসাই বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিবেকের লৌহকপাট খুলতে পারেনি। এদিকে আমাদের বাংলাদেশে শতসহস্র মানুষের বিক্ষোভে শামিল হওয়া কিছু ছদ্মবেশী ছিঁচকে লুটেরাও এই প্রতিবাদের মর্ম উপলব্ধি করেনি। নচ্ছার টাইপের এই দুর্বৃত্ত শ্রেণিটি বিক্ষোভের নামে লুটপাট করেছে। সংখ্যায় কম হলেও এই শয়তানগুলো আমাদের গোটা জাতিকে অসম্মানিত করেছে, ছোট করেছে।
মানুষের প্রতিবাদে-বিক্ষোভে দুনিয়া যখন কম্পমান তখনো গাজায় বোমা পড়েছে, রক্তস্রোত বয়ে গেছে বিধ্বস্ত নগরীর আনাচকানাচে। বিনা বাধায় ইসরায়েলের বোমারু বিমানগুলো যখন আঘাতের পর আঘাত হেনেছে বাড়িতে, হাসপাতালে এবং নানান স্থাপনায়, তখন হামাস রা করেনি। কোনো বিমান ভূপাতিত করা তো পরের কথা, কোথায় কোনো গুলিও ফোটেনি। এর পেছনে হামাসের কৌশলগত কারণ থাকতে পারে। কিংবা থাকতে পারে আরও গভীর কোনো কারণ। সেটা আমরা এই লেখায় দেখার, বোঝার চেষ্টা করব। এক্ষণে ফিলিস্তিনের দুটি পক্ষ- ফাতাহ ও হামাস। এদের নীতি-আদর্শ পরস্পরবিরোধী। ফাতাহ ১৯৯৩ সালের শান্তিচুক্তির ভিত্তিতে স্বাধীন ফিলিস্তিনের দাবি বাস্তবায়ন করতে চায়। ফিলিস্তিনের জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের অগ্রদূত ইয়াসির আরাফাতের রাজনৈতিক দল ফাতাহ ও তাঁর সমমনা রাজনৈতিক সংঘগুলোর সমন¦য়ে ১৯৬৪ সালে গঠিত হয় প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও)। নিজ দেশে পরবাসী বাস্তুচ্যুত এক অসহায় জাতির মুক্তির কান্ডারির ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন ইয়াসির আরাফাত। পিএলওর চাবিকথা বা কিওয়ার্ড- রেভল্যুশন আনটিল ভিক্টোরি। তারা মনে করে তাদের এই সংগ্রাম পর্বতের মতো দৃঢ়; অবিচল, বাতাস পর্বতকে নড়াতে পারে না- ইয়া জাবালা মা ইয়াহজাকরিহ।
পিএলও ১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তির আগে পর্যন্ত আরব ভূখণ্ডে ইসরায়েলের অস্তিত্ব স্বীকার করত না। জর্ডান নদীর তীর থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত ফিলিস্তিন রাষ্ট্র কায়েমই ছিল পিএলওর অভিলক্ষ্য। ভূমধ্য সাগর ও পশ্চিম তীরের মাঝখানে আরব জাহানের নাকের ডগায় বিষফোড়ার মতো ইসরায়েলের অস্তিত্ব স্বীকার করত না। কিন্তু বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। অনাকাক্সিক্ষত হলেও ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ ঘোষণার মাধ্যমে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল আগেই। পশ্চিমা বিশ্ব; প্রধানত আমেরিকার মদতে ইহুদি রাষ্ট্রটি উন্মত্ত ষাঁড়ের মতো গুঁতোগুঁতি শুরু করে জন্মের পর থেকেই। ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে মার্কিন অস্ত্র, বোমা ও বিমানবহরে সজ্জিত ইসরায়েল পশ্চিম তীরের বিরাট এলাকা দখল করে নেয়। এই খ্যাপা ষাঁড়ের দখলে চলে যায় মিসরের সিনাই উপদ্বীপ, গাজাও দখল করে নিয়েছিল ইসরায়েল। ছয় দিনের সেই যুদ্ধে জাজিরাতুল আরবের বুকের ওপর ইসরায়েল নামক বিষফোড়াটি সামরিক শক্তিতে কতটা হিংস্র ও বলীয়ান হয়ে উঠেছিল তখনই তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল। এ ছিল এক রূঢ় বাস্তবতা। কিন্তু ফিলিস্তিনের জনগণ এবং তাদের প্রাণের সংগঠন পিএলও এই বাস্তবতা মেনে নিতে পারেনি। মেনে নেয়নি বহুদিন। অবশেষে ১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তির প্রথম ধাপ সম্পাদনের মাধ্যমে পিএলও ইসরায়েলের অস্তিত্ব স্বীকার করে নেয়। এবং ইসরায়েল পিএলওকে ফিলিস্তিনি জনগণের বৈধ প্রতিনিধি হিসেবে মেনে নেয়, যদিও তখন স¦াধীন ফিলিস্তিনের দাবি মেনে নেওয়ার বিষয়টি উহ্য ছিল। এই শান্তিচুক্তি সম্পাদনের ঐতিহাসিকতার স্বীকৃতিস্বরপ ১৯৯৪ সালে ইয়াসির আরাফাত, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী আইজাক রবিন ও পররাষ্টমন্ত্রী শিমন পেরেজ মিলিতভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন। নরওয়ে এই শান্তিচুক্তি সম্পাদনের পথে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করে। তারই স্বীকৃতি হিসেবে এই চুক্তির নামকরণ করা হয় অসলো চুক্তি। অসলো নরওয়ের রাজধানী। এই শান্তিচুক্তির দলিল স্বাক্ষরিত হয় হোয়াইট হাউসের সবুজ আঙিনায়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন, ইয়াসির আরাফাত ও আইজাক রবিন। সনদে সই করেন ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শিমন পেরেজ ও পিএলওর পক্ষে নির্বাহী সদস্য মাহমুদ আব্বাস। সেই স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে আরাফাত ও রবিন প্রথমবারের মতো করমর্দন করেন। মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসে ও জনমনে সেই করমর্দন চিত্রিত হয়েছিল গভীর রেখায়। কিন্তু আজ সেই করমর্দন ইতিহাসের এক বিস্মৃত অধ্যায়। কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। তবু কেন এমন হলো। এজন্য কে বা কোন পক্ষ কতটা দায়ী? এই প্রশ্নের উত্তর কোনো আবেগের বইয়ে লেখা নেই, বরং নিরাসক্ত মন নিয়ে পরিস্থিতির গভীরে দৃকপাত করা প্রয়োজন।
প্রথমে দেখা যাক, ইসরায়েলের দিকটা। নিষ্ঠুর-নৃশংস বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, তাঁর নেতৃত্বাধীন কট্টর ডানপন্থি লিকুদ পার্টি ও মিত্ররা অসলো শান্তিচুক্তি এক দিনের জন্যও মেনে নেয়নি। ১৯৯৫ সালের নভেম্বরে শোভাযাত্রায় গাড়িতে ওঠার সময় আমির নামের এক অর্থোডক্স ইহুদির গুলিতে আইজ্যাক রবিন নিহত হন। ইসরায়েলের উদারপন্থি ও শান্তিকামী রবিন ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তির মূল্য পরিশোধ করেন জীবন দিয়ে। সেই কট্টরপন্থি জায়নবাদীদের প্রতিনিধিত্ব করেন বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এয়াহুদ ওলমার্ট নেতানিয়াহু সম্পর্কে বলেন, ইসরায়েলের প্রধান শত্রু ইরান নয়; নেতানিয়াহু। তার মানে হচ্ছে নেতানিয়াহু যে চণ্ডনীতি অনুসরণ করে চলেছেন, শেষ পর্যন্ত তা ইসরায়েলকেও বিপর্যস্ত করবে। উল্লেখ্য ইসরায়েলের জনসাধারণের বৃহৎ অংশ গাজায় গণহত্যা সমর্থন করছে না। তারাও গাজা গণহত্যার প্রতিবাদ করছে। পক্ষান্তরে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র কায়েমের পথে প্রধান বাধা ফিলিস্তিনিদের অনৈক্য। লক্ষণীয় ইসরায়েলের উপর্যুপরি হামলায় গাজা নগরী নরকপুরিতে পরিণত হলেও পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ কিন্তু নিশ্চুপ। সেই কর্তৃপক্ষের কোনো রা নেই, কোনো খবর নেই। কিন্তু কেন? কেন এই মৌনতা? বিষয়টি কি তলিয়ে দেখা উচিত নয়? পশ্চিম তীর; যেখানে একটি স্বায়ত্তশাসিত ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ রয়েছে, আজ সেটি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। ঢাল নেই, তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার। গাজার মতো না হলেও পশ্চিম তীরেও ইসরায়েলের হামলা ও দখলদারি অব্যাহত রয়েছে। অসলো শান্তিচুক্তি বলে যে কর্তৃপক্ষ গঠিত হয়েছিল, সেটি বলতে গেলে আজ অকার্যকর। কিন্তু কেন, কেমন করে? এজন্যও দায়ী হামাস ও পশ্চিম তীরের ফাতাহ পার্টির মধ্যকার অনতিক্রম্য প্রকাণ্ড বিরোধ।
হামাস পূর্বাপর পিএলওর প্রতি বিদ্বিষ্ট। মিসরের ব্রাদারহুডের একটি শাথা হিসেবে দলটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮৭ সালে। গাজা উপত্যকায় এদের প্রাধান্য। পশ্চিম তীরেও এদের কিছু সমর্থক রয়েছে। হামাস ইসরায়েলের অস্তিত্ব স্বীকার করে না। জর্ডান নদীর তীর থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত এরা ফিলিস্তিন কায়েম করতে চায়। ইয়াসির আরাফাতের দলও অতীতে তা-ই চাইত। হামাসের দাবি পূরণ হলে মধ্যপ্রাচ্যের বুক থেকে ইসরায়েলের মানচিত্র মুছে যাবে। বিশ্বব্যাপী বিক্ষোভ কর্মসূচিতেও এই সেøাগান শোনা গিয়েছে। কিন্তু কতটা বাস্তবসম্মত এই দাবি- এ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। হামাস পশ্চিম তীরে গৃহযুদ্ধেরও সূত্রপাত করেছে। ফাতাহর সঙ্গে হামাসের সম্পর্ক অহিনকুল। এই সম্পর্ক দ্বিরাষ্ট্র থিউরিকে অসম্ভব করে তুলেছে। এতে পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন সবচেয়ে বেশি ক্ষতি ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীর, যারা নিজ ভূমিতে পরবাসী হয়ে রয়েছেন বহু বছর। ১৯৯৩ সালে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র কায়েমের যে ক্ষীণ সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল আজ যেন তা সোনার পাথরবাটি হয়ে গেছে। কারণ ফিলিস্তিনের অনৈক্য এবং ইসরায়েলি কট্টরপন্থিদের বাড়বাড়ন্ত।
হামাসের কিংবা হামাসের ভিতরে সক্রিয় অপ্রকাশিত কোনো মহলের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক ভক্সমিডিয়ার এক রিপোর্টে একজন কলামিস্টের বরাত দিয়ে নেতানিয়াহুর একটি বক্তব্য প্রকাশ করা হয়। তাতে দাবি করা হয়, ২০১৯ সালে লিকুদ পার্টির কার্যকরী কমিটির এক সভায় নেতানিয়াহু বলেন, স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা আটকাতে হলে আমাদের উচিত হবে হামাসকে তহবিল দিয়ে শক্তি জোগানো। হামাস যত শক্তিশালী হবে, স্বাধীন ফিলিস্তিন তত অসম্ভব হয়ে উঠবে। কাজেই এটাই হবে আমাদের কৌশল। আমরা এ কথা বলব না যে রিপোর্টটি খুবই অথেনটিক। এটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রোপাগান্ডাও হতে পারে। তবে নেতানিয়াহুর উপদেষ্টাদের মাধ্যমে হামাসের জন্য আসা তহবিল কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠেছে খোদ ইসরায়েলের অভ্যন্তরে, যা কাতারগেট কেলেঙ্কারির অংশ হিসেবে বর্ণিত হচ্ছে। কাতারভিত্তিক একটি আন্তর্জাতিক মানি লন্ডারিং চক্রের সক্রিয়তার অভিযোগ কাতারগেট কেলেঙ্কারি হিসেবে পরিচিত। প্রচার প্রোপাগান্ডা যা-ই হয়ে থাকুক না কেন, স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র কায়েমের পথে হামাস ও ফাতাহর বৈরিতা বড় একটি বাধা হয়ে দেখা যে দিয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আর দ্বিরাষ্ট্র থিউরি উপেক্ষা করে আজকের ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় স্বাধীন ফিলিস্তিন প্রতিষ্ঠা করা কঠিন বৈকি!
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক