আসাম লতা। দেশের অধিকাংশ এলাকায় ছড়িয়ে পড়া একটি আগাছা। রিফুজি লতা, জার্মান লতা, যশুরে লতা বা ভিটেছাড়া লতা নামেও পরিচিত উদ্ভিদটি। কেটে গেলে রক্ত বন্ধ করতে এই গাছের পাতার জুড়ি নেই। লিভারের সমস্যা, ডায়াবেটিস, মেছতা ও প্রস্রাবের জ্বালাপোড়া সারাতেও আগাছাটির ব্যবহার বহুল পরিচিত। তবে এর আগ্রাসি চরিত্রের কারণে হুমকিতে আমাদের দেশি গাছ। স্বল্প সময়ের মধ্যেই দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে আশপাশের গাছপালার ওপর জেঁকে বসে। একসময় মৃত্যু হয় অন্য গাছের। আতঙ্কের বিষয় হলো- আসাম লতার মতো প্রায় চার ডজন বিদেশি আগ্রাসি গাছ আমাদের পরিবেশ, কৃষি ও জীববৈচিত্র্যের জন্য এখন হুমকি। এর কিছু সৌন্দর্যবর্ধনের নামে দেশে প্রবেশ করেছে, কিছু প্রবেশ করেছে বনায়নের অজুহাতে, কিছু আবার বাতাসে ভেসে বা অন্য কোনো উপায়ে বর্ডার পাড়ি দিয়ে দেশে ঢুকেছে।
এমনই আরেকটি আগাছা পার্থেনিয়াম। যত্ন ছাড়াই হু হু করে বেড়ে ওঠা একটি ভিনদেশি গুল্মজাতীয় গাছ। আদি নিবাস আমেরিকা অঞ্চলে হলেও বাংলাদেশের অধিকাংশ জেলার মাঠে-ঘাটে, রাস্তার পাশে এখন গাছটির দাপট। এর ছোট ছোট সাদা ফুল মন ভালো করলেও বিষে ভরা শরীর ও দ্রুত বংশবিস্তারের মাধ্যমে অন্য গাছপালা গলা টিপে ধরার ক্ষমতা পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তথ্য বলছে, ফসলের মাঠে পার্থেনিয়ামের বিস্তার ৪০ শতাংশ পর্যন্ত ফলন কমিয়ে দেয়। এ গাছের পাতা পেটে গেলে মানুষ ও পশুপাখির মৃত্যু ঘটতে পারে।
বাংলাদেশে এ পর্যন্ত প্রায় ৩০০ প্রজাতির বিদেশি উদ্ভিদ চিহ্নিত করতে পেরেছেন গবেষকরা। এর মধ্যে ৪৬টি প্রজাতির উদ্ভিদকে আগ্রাসি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যা স্থানীয় প্রজাতির জন্য হুমকি। এসব গাছ দ্রুত বাড়ে, দ্রুত বংশবিস্তার করে, বেশি খাবার ও পানি গ্রহণ করে। ফলে এই গাছের আশপাশে অন্য গাছ বাড়তে পারে না। অনেক গাছ বিষাক্ত হওয়ায় পাখি বাসা বাঁধে না। ফল খায় না। ২০২০ সালে বিজ্ঞান সাময়িকী গ্লোবাল ইকোলজি অ্যান্ড কনজারভেশনে প্রকাশিত এক গবেষণায় বাংলাদেশে ৪৬ প্রজাতির আগ্রাসি উদ্ভিদের কথা বলা হয়েছে, যা এই ভূখণ্ডে ব্যাপকভাবে জন্মায় ও অন্য গাছপালা এবং পশুপাখির ক্ষতি করে। প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর জোট আইইউসিএন বিশ্বের ১০০টি শীর্ষ আগ্রাসি প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণীর তালিকা তৈরি করেছে। তাতে ওই ৪৬ প্রজাতির সবকটির নাম রয়েছে। আর এই আগ্রাসি গাছের কারণে অনেক দেশি গাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে, অনেক গাছ সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে বলে বিভিন্ন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
তথ্য বলছে, ব্রিটিশ আমলে বিদেশ থেকে এ অঞ্চলে আসে রেইনট্রি, মেহগনি, চাম্বুলসহ কিছু গাছ। আশির দশকে আনা হয়েছে আকাশমণি, ইউক্যালিপ্টাস, শিশু, ইপিলইপিল, বাবলা ও খয়ের জাতীয় গাছ। ২০১৭ সালেও উচ্চমূল্যে চীন ও তাইওয়ান থেকে বনসাই এনে লাগানো হয় রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কের দুই পাশে। এ ছাড়া রিফুজি লতা, লান্টানা বা লণ্ঠন, স্বর্ণলতা, বনমটমটিয়া, পিসাইস, পার্থেনিয়াম, কচুরিপানাসহ বেশ কিছু লতা ও গুল্ম অনুমতি ছাড়াই বিভিন্ন পথে দেশে ঢুকে পড়েছে। উভয় ধরনের উদ্ভিদ মিলে গত কয়েক দশকে আমাদের নিজস্ব ইকোসিস্টেমকে বিপর্যস্ত করে ফেলেছে। কয়েক দশক আগে যেখানে শাপলা ও পদ্ম মিলত, সেই জায়গা এখন দখলে নিয়েছে কচুরিপানা।
শালবনের দখল নিয়েছে ইউক্যালিপ্টাস আর রিফুজি লতা নামের আগাছা। সম্প্রতি সরকার ১ হাজার উদ্ভিদ প্রজাতির একটি লাল তালিকা তৈরি করেছে। তালিকা অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের ৩৯৫টি উদ্ভিদ প্রজাতি বিপদাপন্ন, যার মধ্যে ৫টি মহাবিপন্ন, ১২৭টি বিপন্ন এবং ২৬৩টি সংকটাপন্ন। ২৭১টি প্রজাতির উদ্ভিদ ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত। ২৫৬টি প্রজাতির তথ্য অপ্রতুল। এ ছাড়া ৭০টি প্রজাতিকে প্রায় বিপদগ্রস্ত এবং সাতটি উদ্ভিদ আঞ্চলিকভাবে বিলুপ্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ১৭টি আক্রমণাত্মক উদ্ভিদ প্রজাতি চিহ্নিত করেছে সরকার, যেগুলো পরিবেশের জন্য ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনছে।
উদ্ভিদবিদ ও গবেষকরা বলছেন, এসব আগ্রাসি গাছের কারণে দেশি গাছ ও জীববৈচিত্র্য হুমকিতে। এক সময় বাংলাদেশে প্রায় ৫ হাজার প্রজাতির বৃক্ষ থাকলেও সাম্প্রতিক গবেষণায় ৩ হাজার ৮১৩টি প্রজাতির রেকর্ড করা গেছে। হাজারখানেক প্রজাতির বৃক্ষ আর দেখা যায় না। অনেক বিষাক্ত গাছ না চিনে মানুষ ড্রয়িং রুমে, বেলকনিতে রাখছে। নার্সারিতেও বিক্রি হচ্ছে এসব আগ্রাসি গাছ। কোন গাছ লাগানো যাবে, বিক্রি বা আমদানি করা যাবে এর একটা সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন থাকা দরকার। প্রাইমারি থেকেই পাঠ্য বইয়ে আগ্রাসি গাছ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের বিষয় রাখতে হবে। প্রকৃতিতে কোনো সৃষ্টিই অপ্রয়োজনীয় নয়। আগ্রাসি গাছগুলো কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে বা উপকারে লাগানো যাবে তা জানতে গবেষণা প্রয়োজন।