সকাল ১০:১৫ টায় অফিসে ঢুকতেই হাজতে পাহারারত কনস্টেবল বললো স্যার একটা মেয়ে হারায় গেছে, শুধুই কানতাছে (কাঁদছে)! মেয়েটির নাম রিমা, বয়স ১৪ বছর। কথা বলছি আর বুঝছি রিমা আমাকে একের পর এক মিথ্যা তথ্য দিয়েই যাচ্ছে! পরিবারের কেউই তাকে ভালবাসেনা, আপন মাকে সৎ মা বানিয়ে ফেলা, পড়ালেখা না করতে দেয়া সব মিথ্যা এক নিশ্বাসে বলেই যাচ্ছিল। পাশেই অবস্থানরত পিএসআইদের বললাম " ওহ মিথ্যা বলছে"।
কিছুক্ষন পর পরিবারের কারো মুঠো ফোন নম্বর জানা আছে কিনা বলতেই রিমা তার মর্জিনা খালার নম্বর দিল। মর্জিনা খালা ভাগ্নীকে নিয়ে মোটেই উদ্বিগ্ন নন! তিনি বললেন, "একটা বাসে উঠায়া দেন, আপনা আপনি চইলা(চলে) আসবো"! কাউকে নিজ হেফাজতে আনার পর পুলিশ জিম্মাদার ছাড়া কাউকে ছেড়ে দিতে পারেনা, এই সহজ সমীকরণ গ্রামের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অংশ মর্জিনা খালার মাথায় কোনভাবেই প্রবেশ করাতে সক্ষম হয়না পুলিশ!
রিমা সবকিছুই জানে, কিন্তু হারিয়ে যাওয়া বাচ্চাকে পাওয়া গেলে আমরা সাধারণত যে পদ্ধতি অনুসরণ করি তা হলো আস্তে আস্তে গল্প জুড়ে দেয়া, চকলেট, বিস্কুট দিয়ে সম্পর্ক গভীর করা, তার মত করে বলতে শেখা এবং বিভিন্ন প্রশ্নের মাধ্যমে প্রত্যাশিত উত্তর বের করে আনা! এক্ষেত্রে পারিবারিক বিষয়ের পাশাপাশি থানা, জিলা, স্কুল, নিকটস্থ মাঠ, বাজার, গ্রাম, মাদ্রাসা, বাসস্ট্যান্ড,বাস,মেম্বার, চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন এসব বিষয়ক প্রশ্ন করলে সহজেই বের করা যায় বাচ্চা কোন এলাকার বাসিন্দা! সর্বাধিক ক্ষেত্রে এলাকার চেয়ারম্যান, মেম্বারগণ সহায়তা করে থাকেন।
যাত্রাবাড়ী এলাকায় খুঁজে পাওয়া ৪০ এরও অধিক বাচ্চাকে উপরোক্ত প্রক্রিয়া ও সামাজিক মাধ্যমের সহায়তায় তাদের নিজ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা গেছে।
রিমা তার বাসায় ফিরতে চায়না! চাঁদপুরের মেয়ে রিমার লেখাপড়ায় মন নেই, বাবা মায়ের শাসন ভাল লাগেনা তাই ঢাকায় এসেছে মুক্তির নিশ্বাস নিতে!!
স্বেচ্ছায় পথ হারিয়ে ফেলা রিমা পথ ফিরে পেয়েও ফিরতে চায়না। তাকে অবশেষে তার নিজ চাচার জিম্মায় বুঝিয়ে দেয়া হয়। ফিরে যাওয়ার পথে নিজের বলা মিথ্যার জন্যই সম্ভবত আমার চোখে চোখ রাখতে পারছিল না সে....!
রিমার বিষয়টি দেখতে না দেখতেই পিএসআই রাজু খুব মিষ্টি চেহারার ছোট্ট ছেলে শিহাবকে নিয়ে রুমে আসে। পিএসআই রাজু শিহাবকে নিয়ে খুব খেটেছে।
শিহাব বেশ চটপটে। ১৩ বছর বয়সী শিহাব কুমিল্লার দেবিদ্বার এলাকার(যদিও তখন পর্যন্ত জানতাম না!) আমার রুমে ঢুকেই ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ে। অনুমতির বালাই নেই! প্রশ্ন করতেই উত্তর দেয় আর বলতে থাকে আমার ভুলে যাওয়া রোগ আছে! তথ্য সেটুকুই দেয় যা দিয়ে তার ঠিকানা পাওয়া যাবেনা ) হঠাৎ করে বললো "আমি সকাল থেকে কিছু খাইনি" পোলাও আর রোস্ট তার প্রিয় খাবার। মধ্যাহ্নভোজ শেষে জানা গেল পুরো দেবিদ্বার থানা এলাকায় পিএসসিতে প্রথম হয়েছিল শিহাব!!
শিহাব বাবা মায়ের কাছে যাবেনা! বাবা মা তাকে অনেক ভালবাসে তাও যাবে না! পুলিশ আংকেলদের কাছে থাকবে সে! কেন যাবেনা তার উত্তর নেই, থানায় ফ্লোরে ঘুমাবে তাও বাসায় যাবে না! শিহাবের মামা আশা এনজিওতে চাকরি করেন। তিনি চলে আসলেন আদরের ভাগ্নেকে নিতে। শিহাব বাংলা, ইংরেজি দুই বিষয়েই অতিশয় দক্ষ। ছোট্ট মেধাবী শিহাব পথ জেনেও পথ খুঁজে পেতে চায়নি, কে জানে কিসের টানে?
অজানা ভালবাসায় পথিক আকৃষ্ট হলে তা রুপান্তরিত হয় উভমুখী ভালবাসায়! হয়তোবা সেই অজানা, অচেনা ভালবাসাই পথিককে করে তুলে দ্বিধান্বিত! পথিক তখন পথ খুঁজে পেয়েও পেতে চায়না।
ভালবাসার ছোঁয়ায় রাঙিয়ে যাক জগতের প্রতিটি শিশু প্রাণ....।
লেখক: সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার (ডেমরা জোন)
(লেখকের ফেসবুক পেইজ থেকে সংগৃহীত)
বিডি-প্রতিদিন/ সালাহ উদ্দীন