আমি যখন প্রথম পিএচডি করতে গেলাম নেদারল্যান্ডসে'র লাইডেন ইউনিভার্সিটি'তে, শহর'টা সম্পর্কে আমার কোন ধারণা ছিল না।
ডেনমার্কের কোপেনহেগেন এয়ারপোর্ট থেকে প্রথমে যেতে হবে আমস্টারডাম এয়ারপোর্টে। সেখান থেকে ট্রেনে করে লাইডেন।
সমস্যা হচ্ছে, আমি আমস্টারডাম এয়ারপোর্টে পৌঁছাবো গভীর রাতে। অত রাতে ট্রেনে করে আবার লাইডেনে যেতে পারব কি না ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
আমি ই-মেইল করে আমার সুপারভাইজার, মানে প্রফেসর'কে জিজ্ঞেস করলাম
-অত রাতে ট্রেনে করে লাইডেনে পৌঁছান যাবে কিনা?
প্রফেসর আমার'কে সঙ্গে সঙ্গে মেইল করে লিখলেন
-তুমি রাতের শেষ ট্রেন'টা পেয়ে যাবে। এয়ারপোর্ট থেকে নেমে'ই ট্রেন'টা ধরতে হবে। ট্রেন মাঝ পথে একটা ষ্টেশনে থামবে। আমি সেই ষ্টেশন থেকে ট্রেনে উঠে তোমাকে খুঁজে নিব। আমি'ই তোমাকে তোমার হোস্টেলে পৌঁছে দিব।
মেইল পেয়ে আমি পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হলাম।
মাত্র'ই মাস্টার্স শেষ করেছি সুইডেনে'র লুন্ড ইউনিভার্সিটি থেকে। বয়েস তখন ২৩ কি ২৪! অত কিছু ভালো করে বুঝিও না।
রওনা হলাম নেদারল্যান্ডসে।
রাত প্রায় সাড়ে ১২'টা। আমস্টারডাম এয়ারপোর্টে পৌঁছে'ই দ্রুত উঠে পড়লাম ওদের দ্রুত গতি'র দোতলা ট্রেনে।
গভীর রাতের ট্রেন। খুব একটা মানুষজন নেই।
তখন মোবাইল ইন্টারনেট ছিল না। আমার কাছে রোমিং মোবাইলও নেই। ভাবছিলাম এতো বড় ট্রেনে আমার এই প্রফেসর কি আদৌ আমাকে খুঁজে পাবে!
পরের স্টেশনে ট্রেন মিনিট খানেক থেমে আবার চলা শুরু করেছে।
আমি ভাবছি- প্রফেসর কি আদৌ ট্রেনে উঠতে পেরেছে!
খানিক বাদে'ই দেখি বিশাল দেহের মানুষ'টা হাসি হাসি মুখে আমার সামনে এসে বলছে
-ইউ মেইড ইট! অভিনন্দন তোমাকে।
ভদ্রলোকের বয়েস কেমন হবে- ৫৫ থেকে ৬০ এর মতো। অভিবাসীদের নিয়ে যারা গবেষণা করে, তাদের মাঝে এই প্রফেসরের বেশ নাম-ডাক পৃথিবী'তে। তার অনেক গবেষণা পত্র আমি নিজে'ই পড়েছি।
আমি ভাবছিলাম, সে নিশ্চয় বেশ রাশভারী স্বভাবের হবে। এতো বড় প্রফেসর, সে যে নিজে ট্রেনে চড়ে বসেছে আমাকে রিসিভ করতে, এতে'ই আমি বেশ অভিভূত হয়েছিলাম।
অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম ভদ্রলোক খুব'ই সহজ স্বাভাবিক ভাবে আমার সঙ্গে কথা বলছে। আলাদা কোন রাশভারী ভাব নেই। কি চমৎকার করে হাসি মুখে ক্রমাগত কথা বলে যাচ্ছে।
ট্রেনে বসে প্রথমে তিনি শুরু করলেন- নেদারল্যান্ডস দেশটা কেমন, যেই শহরে যাচ্ছি সেই শহর'টা কেমন, ইউনিভার্সিটি, ডিপার্টমেন্ট সব কিছু'ই তিনি খুব অল্প সময়ে ব্যাখ্যা করলেন।
লাইডেন শহরে যখন নেমেছি, তখন মাঝ রাত পার হয়ে গিয়েছে। ভদ্রলোক আমাকে নিয়ে গেলেন আমার হোস্টেলে।
হোস্টেলে পৌঁছে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন
-আমিনুল, তুমি কি খুব ক্লান্ত?
আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম
-না, মোটে'ই ক্লান্ত না। মাত্র তো ঘণ্টা কয়েকের জার্নি করে এসেছি।
এবার সে বেশ চমৎকার হাসি দিয়ে বললেন
-চলো, তোমাকে তাহলে রাতের লাইডেন শহর'টা ঘুরে দেখাই। তাহলে তুমি'ও প্রয়োজনীয় জায়গাগুলো চিনে নিতে পারবে।
এরপর প্রফেসর আমাকে পাশের সুপার মার্কেট, সিটি সেন্টার, সেকেন্ড হ্যান্ড শপ, এমনকি ইউনিভার্সিটি বিল্ডিং এও ঘুরিয়ে নিয়ে আসলেন।
দুজনে মিলে হাঁটছি, এমন সময় তিনি বললেন
-একটু শীত শীত লাগছে। তবে এখনো তো খুব একটা ঠাণ্ডা জেঁকে বসে'নি। তোমার মনে হয় খুব ঠাণ্ডা লাগছে। আমি ভাবছিলাম তুমি আইসক্রিম খাবে কিনা। এখানে একটা আইসক্রিম শপ গভীর রাত পর্যন্ত খোলা থাকে।
ভদ্রলোক এমন ভাবে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, দেখে মনে হচ্ছিলো, আমাকে জিজ্ঞেস করে'ই তিনি মহা-অন্যায় করে ফেলেছেন।
আমি সঙ্গে সঙ্গে বলেছি
-নিশ্চয় খাব। আমার মোটে'ই ঠাণ্ডা লাগছে না।
এরপর দুজনে মিলে আইসক্রিম শপ থেকে আইসক্রিম কিনে লাইডেনের রাস্তায় হেঁটে বেড়িয়েছি। এর ফাঁকে ফাঁকে প্রফেসর বলে চলেছে শহরটা সম্পর্কে, ইউনিভার্সিটি সম্পর্কে ইত্যাদি।
মৃদু-মন্দ বাতাস, হালকা ঠাণ্ডা, রাতের আলো-আধারি। আমরা হাঁটছি আর আইসক্রিম খাচ্ছি। কি এক মায়াবী রাত্রি।
সেই রাতের কথা আমি আমার এই এক জীবনে বোধ করি কোন দিন ভুলবো না।
এতো বড় প্রফেসর, পৃথিবী জুড়ে যার এতো নাম-ডাক, সে কিনা আমাকে রিসিভ করতে ট্রেনে চড়ে বসেছে! শুধু তাই না, আমাকে হোস্টেলে পৌঁছে দিয়েছে, গভীর রাতে শহর ময় ঘুরে বেড়িয়েছে, যাতে প্রয়োজনীয় জায়গা গুলো আমি চিনে নিতে পারি।
এই ছিল নেদারল্যান্ডসে আমার প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা।
পরের দিন যখন ইউনিভার্সিটি'তে গেলাম, প্রফেসর পরিচয় করিয়ে দিলেন ডিপার্টমেন্টের অন্যান্য পিএচডি স্টুডেন্টদের সঙ্গে।
এরপর অন্যান্য পিএচডি স্টুডেন্ট'রা সবাই মিলে আমাকে কি চমৎকার করে'ই না ব্রিফ করল ছোট-খাটো বিষয় গুলো। এই যেমন প্রিন্ট করতে চাইলে কিভাবে করতে হবে, বই কিভাবে লাইব্রেরি থেকে নিতে হবে ইত্যাদি।
এরপর সবাই বিলে আমাকে ক্যানটিনেও নিয়ে গেল। খেলাম এক সঙ্গে।
কি চমৎকার একটা পরিবেশ।
এই ছিল আমার প্রথম অভিজ্ঞতা।
আর আমাদের দেশে?
শিক্ষক'রা প্রথম দিনে'ই এমন একটা ভাব ভঙ্গী করে- দেখে মনে হবে উনারা হচ্ছেন প্রভু কিংবা ঈশ্বর টাইপ কেউ! উনাদের ধারে- কাছেও যাওয়া যাবে না!
আর বড় ভাই'রা?
তারা তো র্যাগিং দিয়ে বেড়াচ্ছে!
কাল দেখলাম দেশের কোন এক ইউনিভার্সিটি'র দুই ছেলে'কে এমন সব বাজে ভাষায় রেগিং করে এমন অবস্থা করেছে, এক ছেলে নাকি অজ্ঞান'ই হয়ে গিয়েছে!
এরা এমন ভাষা ব্যবহার করেছে, অন্তত আমার এই লেখায় সেই শব্দগুলো ব্যাপার করতে আমার রুচি'তে বাঁধছে। অথচ এরা শুধু এমন ভাষা ব্যবহার করে'ই থেমে থাকে'নি; সেটা ভিডিও করে বীর দর্পে ছেড়েও ছিয়েছে!
এদের কথা বলার ধরণ শুনে আমার এদের'কে ছাত্র মনে হয়'নি, মনে হয়েছে এরা হয় কোন সন্ত্রাসী বাহিনী'র সদস্য, নয়ত পাড়ার বখাটে-মাস্তান!
আবার এই ঘটনা জানার জন্য কাল রাতে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক এবং প্রক্টর আসলেন টেলিভিশনে।
টেলিভিশনের সঞ্চালক তাকে জিজ্ঞেস করলেন এই র্যাগিং সম্পর্কে বলতে। তো, উত্তরে এই ভদ্রলোক "র্যাগিং" এবং "র্যাগ ডে" কে এক করে ফেললেন!
এরপর সঞ্চালক রীতিমত অবাক হয়ে বললেন,
-র্যাগিং দেয়া আর র্যাগ'ডে কে এক বলতে চাইছেন? আচ্ছা বলুন তো র্যাগিং আর র্যাগ'ডে মানে কি?
অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম ওই শিক্ষক এর উত্তর'টা পর্যন্ত দিতে পারলেন না!
বিরক্ত হয়ে টেলিভিশনের সঞ্চালক শেষমেশ টেলিফোনের লাইন'টাই কেটে দিলেন!
এই হচ্ছে আমাদের শিক্ষক এবং ছাত্র'দের অবস্থা। কিংবা সামগ্রিক ভাবে বলতে চাইলে- আমাদের পুরো সিস্টেমের অবস্থা!
আমি ১১ বছর পরও নেদারল্যান্ডসে আমার প্রথম দিন গুলো ভুলতে পারিনি। কি মায়াবী একটা পরিবেশ ছিল। গভীর রাতে প্রফেসর আমাকে নিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছেন, আইসক্রিম কিনে দিচ্ছে। আহা, কি চমৎকার সব স্মৃতি।
আর আমাদের ছাত্র-ছাত্রী'দের ইউনিভার্সিটি জীবনের প্রথম অভিজ্ঞতা হচ্ছে- বড় ভাই'রা আচ্ছা মতো গালাগালি করে যা ইচ্ছে তাই বলে বেড়াচ্ছে, এমন কি মার পর্যন্ত দিচ্ছে! কিংবা শিক্ষক'রা বলছে- আমরা'ই এখানে ঈশ্বর!
মনে হয় বিশ্ববিদ্যালয় পাঠশালা না, কোন যুদ্ধ ক্ষেত্র!
তো, এই ছাত্র-ছাত্রী'রা তাদের বাদ বাকী জীবনে তো এইসব'ই মনে রাখবে।
দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো'র পড়াশুনা মান কিংবা শিক্ষক'দের যে কেউ এখন আর সম্মান করতে চায় না, এর কারণ তো এইসব'ই।
আপনাদের সামনে প্রকাশ্য-দিবালোকে একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছেলে-পেলে'রা এইসব করে বেড়াচ্ছে, ভিডিও করে ছেড়ে দিচ্ছ, আর আপনারা টেলিভিশনে এসে বলছেন- র্যাগ'ডে তে তো ছেলে-পেলেরা মাঝে মাঝে এমন করে'ই!
আমার মনে হয় কি, ছাত্র-ছাত্রী'দের আপনারা কি শিক্ষা দিবেন! আগে আপনারা বরং ভালো করে শিখুন, এরপর না হয় শিক্ষা দেবার চিন্তা ভাবনা করবেন!
(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)
বিডি প্রতিদিন/ফারজানা