মাসুদ মাহমুদ আমার সরাসরি শিক্ষক। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজী বিভাগে তিনি আমাদের পড়িয়েছেন। টিউটরিয়াল কিংবা মৌখিক পরীক্ষায় তিনি শিক্ষার্থীদের কম নম্বর দিতেন। কেবল তিনিই নন- প্রায় সব শিক্ষকই কম নম্বর নিতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের আর কোনো বিভাগেই বোধ হয় শিক্ষার্থীরা টিউটরিয়াল বা মৌখিক পরীক্ষায় ভগ্নাংশে নম্বর পেতো না। ডিপার্টমেন্ট এর প্রবীন শিক্ষক নিলুফার ম্যাডাম তো একদিন শাউট করেই বলে ফেলেছিলেন- ‘একজন শিক্ষার্থী যখন কোনো টিচারের রুমে ঢুকে চেয়ার টেনে বসতে পারে- তখনি তাকে মৌখিক পরীক্ষায় পাশ নম্বর দেয়া উচিৎ। এঁরা (শিক্ষকরা) ভুলে যায়- তারা কোনো শিক্ষককে নয়- শিক্ষার্থীদের নম্বর দিচ্ছে।
বিদেশি সাহিত্য পড়ান যে শিক্ষকরা – সেই শিক্ষকরা সব সময়ই এমন গম্ভীর হয়ে ক্লাশে আসতেন কিংবা ডিপার্টমেন্ট এর করিডোর দিয়ে হাঁটতেন যে তাদের দূর কোনো গ্রহের বাসিন্দাই মনে হতো। একমাত্র মুহিত স্যারকেই মনে হতো- যিনি হাসতে পারেন, আর বাকিদের কেউ হাসতে পারেন- এমনটাই মনে হতো না।
একজন স্যারকে নিয়ে আমরা খুবই ঠাট্টা করতাম। অবশ্যই আড়ালে। স্যার ক্লাশে আসার সময় মুখে চিরতা দিয়ে আসেন’- এটা ছিলো স্যারকে নিয়ে আমাদের কমন কথা। স্যারকে কেউ কখনো হাসতে দেখেছে কী না, তা নিয়েও আমাদের প্রচুর গবেষণা হতো। সেই স্যার হঠাৎ একদিন ডিপার্টমেন্ট এর পাশের সিঁড়ি দিয়ে নচে নামতে নামতে ইশারায় ডাকলেন। ক্যাম্পাসে তখন তুমুল নিরাপত্তাহীন অবস্থা। প্রগতিশীল ছেলে মেয়েরা শিবিরের সন্ত্রাসের শিকার হচ্ছে প্রতিদিনই। দু'দিন আগেই শিবিরের নির্যাতনের শিকার হয়েছি আমি নিজেও।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে কাঁধে হাত রাখলেন স্যার। খুব একটা খারাপ সময়ে ক্যাস্পাসে তোমাদের একা রেখে আমি বিদেশে যাচ্ছি। খারাপ লাগছে বাপ...
কেমন জানি গলাটা ধরে আসে, চোখ ভিজতে শুরু করে আমার। যেই স্যারকে কোনো দিনই হাসতে দেখিনি আমরা, সেই স্যারের মনের ভেতর শিক্ষার্থীদের জন্য এতো ভালোবাসা।
কথা শুরু করেছিলাম মাসুদ মাহমুদ স্যারকে নিয়ে। চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান তিনি। তাঁর বিরুদ্ধে নাকি ডিপার্টমেন্টের ২২ জন শিক্ষার্থী ‘মারাত্মক’ কিছু অভিযোগ তুলেছে। ইংরেজি সাহিত্যের এই অধ্যাপক না কি সাহিত্য পড়াতে গিয়ে ‘যৌনউত্তেজক’ কথা বার্তা বলেন। অভিযোগের ফিরিস্তি শুনে হাসবো না কাঁদবো- বুঝে উঠতে পারছি না। মাসুদ মাহমুদ যখন আমাদের পড়িযেছেন- তখন তো উনার বয়স আরো কম ছিলো। তখন কি তিনি কখনো এমন কিছু ক্লাশে বলতেন- যা আমাদের ‘অনুভূতি’কে আহত করেছে!- মনে করতে পারছি না কিছুতেই।
মাসুদ মাহমুদের মতো স্যারকে নিয়েও তার ছাত্রছাত্রীরা অভিযোগ তুলেন, সেই অভিযোগ ডিসি, এসপি, মন্ত্রীর কাছে যায়- এটা ভাবতেও খারাপ লাগছে। নর্থসাউথেও তিনি পড়িয়েছেন, আরো বেশ ক'টি বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি পড়িয়েছেন, কোথাও তাকে নিয়ে কোনো কথা হয়নি। এখন কেন হচ্ছে?
বিষয় সম্পর্কে ভালোভাবে না জেনে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে চাই না আমি। তবে এই বয়সে এসে মাসুদ মাহমুদ স্যার যেনো অন্যায়ভাবে অপমানিত না হন- সেটা মনে প্রাণে চাইবো।
(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)
বিডি প্রতিদিন/ফারজানা