ভাষাসৈনিক ও সাংবাদিক মাহবুব আনাম বলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি হচ্ছে মুসলমান, আমাদের ধর্ম এবং আমাদের ঐতিহ্য—সব মিলেই আমাদের সংস্কৃতি। সেই সংস্কৃতিকে যদি আমরা এগিয়ে নিয়ে না যাই, তাহলে আমাদের মস্ত বড় ভুল হবে
মানবসমাজে যে বর্ণিল ও বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি বিদ্যমান, ইসলাম তাকে আল্লাহর কুদরতের নিদর্শন মনে করে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের প্রত্যেকের জন্য শরিয়ত ও স্পষ্ট জীবনপ্রণালী দান করেছি।’
(সুরা : মায়িদা, আয়াত : ৪৮)
উল্লিখিত আয়াতে ‘জীবনপ্রণালী’ দ্বারা ভাষা, শিক্ষা, সংস্কৃতিসহ জীবনঘনিষ্ঠ সবকিছুই উদ্দেশ্য।
সংস্কৃতি বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর পরিচয়কে পৃথক করে। তাই পরিচয় নির্ণয় করে এমন সংস্কৃতি যদি দ্বিনবিরোধী না হয়, তাহলে তা রক্ষা করা প্রয়োজন। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মানুষ! আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী থেকে, পরে তোমাদের বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হতে পারো।’
(সুরা : হুজুরাত, আয়াত : ১৩)
সংস্কৃতি ও ইসলামী সংস্কৃতি
বিখ্যাত ব্রিটিশ কবি টি এস এলিয়ট বলেন, ‘সংস্কৃতি হলো বিশেষ স্থানে বসবাসকারী বিশেষ লোকদের জীবনধারা ও জীবনপদ্ধতি, যার বৈশিষ্ট্য হলো ভাবগত ঐক্য ও প্রকাশক্ষেত্রের সৌন্দর্য।’(নোটস টুওয়ার্ডস দ্য ডেফিনিশন অব কালচার, পৃষ্ঠা-১৩)
উল্লিখিত সংজ্ঞার আলোকে বলা যায়, মুসলমানদের জীবনধারা ও জীবনপদ্ধতিই ইসলামী সংস্কৃতি, যা মুসলমানের অভিন্ন বিশ্বাস ও দৈনন্দিন আচরণের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। ইসলামী চিন্তাবিদ ও লেখক আবদুস শহীদ নাসিম বলেন, ইসলামী বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও মূলনীতির আলোকে যে জীবনবোধ, জীবনচেতনা, সমাজচেতনা ও মানবতাবোধ সৃষ্টি হয়, সেগুলোই ইসলামী সংস্কৃতি।
(শিক্ষা সাহিত্য সংস্কৃতি, পৃষ্ঠা-১৯)
ইসলামী সংস্কৃতির স্বরূপ
১৯৮২ সালে মেক্সিকো শহরে ইউনেসকো সংস্কৃতি বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করে, যাতে বলা হয়, ‘কোনো একটি একক সংস্কৃতি তার সর্বজনীনতা স্বীকার করার পক্ষে যথেষ্ট নয়। পৃথিবীর অন্যান্য সংস্কৃতির সঙ্গে তার সম্পর্ক গড়তেই হবে এবং এই সম্পর্ক স্থাপনের মধ্য দিয়ে সে তার নিজের অস্তিত্ব প্রমাণ করবে।
সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য ও বৈচিত্র্য একে অন্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।’ (আমাদের সংস্কৃতি : বিচার্য বিষয় ও চ্যালেঞ্জসমূহ, পৃষ্ঠা-১৬) সংস্কৃতির এই সম্মিলন ও আত্তীকরণের বৈশিষ্ট্যকে ইসলাম অস্বীকার করে না, বরং ইসলাম পৃথিবীর যেকোনো ইতিবাচক সংস্কৃতি গ্রহণের ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করে।
ড. হাসান জামান লেখেন, ‘ইসলামী জীবনদর্শন সব দেশ, কাল, দর্শন ও তমদ্দুন থেকে বিনয়ের সাথে যা কিছু সুন্দর মহান চিরন্তর, কল্যাণকর, তাকে সাদরে বরণ করে নিতে উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছে বারে বারে। তবে যেসব ভাল জিনিস গ্রহণ করা হলো, তাকে ইসলামী ভাবধারায় সমৃদ্ধ ও তৌহীদবাদ দ্বারা সঞ্জীবিত করে তুলতে হবে। ইসলামী সংস্কৃতি সব মানুষের, সব জাতির, দেশের ও কালের সংস্কৃতি।’
(সমাজ, সংস্কৃতি ও সাহিত্য, পৃষ্ঠা-২)
তিনি আরো বলেন, ‘বিভিন্ন সংস্কৃতি ও ভাবধারার সার্থক অনুপ্রবেশ ইসলামের কাম্যও। এ জন্যই ইসলামে মৌলিক নীতি অক্ষুণ্ন রেখে সামাজিক চাহিদা ও পরিবেশমাফিক নীতিকে বাস্তবে রূপায়িত করতে বলা হয়েছে। এর নাম ইজতিহাদ।’
(সমাজ, সংস্কৃতি ও সাহিত্য, পৃষ্ঠা-২)
বাঙালি সংস্কৃতিতে ইসলামের প্রভাব
সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ইসলামের মূলনীতি ‘আত্তীকরণের’ কারণেই বাংলা অঞ্চলে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর স্থানীয় বহু সংস্কৃতি মুসলিম সমাজে যুক্ত হয়েছে, তেমনি স্থানীয় সংস্কৃতিতেও এসেছে নানামুখী পরিবর্তন। বর্তমানে চর্চিত বাঙালি সংস্কৃতির অন্তরাত্মার সঙ্গে ইসলামের গভীর সেতুবন্ধ রয়েছে। ইসলাম আগমনের পর এই অঞ্চলের ভাষা, পোশাক, খাদ্যের পাশাপাশি সামাজিক বিন্যাস পর্যন্ত পরিবর্তন হয়ে যায়। ঔপনিবেশিক মুসলিম বিদ্বেষী ব্রিটিশ শাসন এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় দুই শ বছরের প্রবল প্রতাপশালী হিন্দু জমিদারির প্রভাবে বাঙালি সংস্কৃতিতে মুসলমানের প্রভাব কিছুটা ম্রিয়মাণ হয়েছে সত্য, তবে এটা ধ্রুব সত্য যে বাঙালি সংস্কৃতিতে মুসলমানের ‘অংশ ও অবদান’ অন্য যেকোনো জাতি-গোষ্ঠীর তুলনায় অনেক বেশি দৃশ্যমান। অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান তাঁর এক প্রবন্ধে বাঙালি সংস্কৃতিতে ইসলাম ধর্মের প্রভাব সম্পর্কে বলেন, ‘আমাদের সংস্কৃতিতে যেসব বিভিন্ন উপকরণের মিশ্রণ ঘটেছে, তার মধ্যে ধর্মীয় উপকরণটি প্রধান ও প্রবলতম। প্রধান ও সংখ্যাগরিষ্ঠদের ধর্ম হিসেবে ইসলামের প্রভাব বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে একটি প্রবল প্রভাব। এর সঙ্গে অবশ্য বৌদ্ধ প্রভাব, হিন্দু প্রভাব ও খ্রিস্টান প্রভাব মিলিত হয়েছে।’ (আমাদের সংস্কৃতি : বিচার্য বিষয় ও চ্যালেঞ্জসমূহ, পৃষ্ঠা-১৮)
তিনি বাংলা অঞ্চলে মুসলিম শাসনামলে হওয়া বেশ কিছু সাংস্কৃতিক পরিবর্তন তুলে ধরেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো—
১. মানুষে-মানুষে ভেদাভেদ দূরীকরণের মাধ্যমে একটি সাম্যবাদী প্রবৃত্তির প্রতিষ্ঠা।
২. নগর নির্মাণ ও নগরায়ণের মাধ্যমে এ দেশের সংস্কৃতির গ্রামীণ প্রকৃতির মধ্যে পরিবর্তন সাধন।
৩. স্থাপত্য শিল্পে একটি নতুন মাত্রা সংযোজন এবং মসজিদ ও দুর্গের স্থাপত্যরীতির পরিবর্তন।
৪. দেশজ ভাষা চর্চায় উৎসাহ প্রদান এবং একটি উদার অসাম্প্রদায়িক ভাবপ্রকল্পের জন্মদান।
৫. সেন আমলে সংস্কৃত ভাষার যে প্রভাব ছিল সেই প্রভাব দূরীকরণ।
৬. বাংলা ভাষার রূপ ও রীতির পরিবর্তন (আধুনিকায়ন অর্থে) এবং প্রচুর পরিমাণে আরবি, ফারসি শব্দের আত্তীকরণ।
৭. বাঙালির খাদ্যাভ্যাস ও রন্ধনপ্রণালীতে পরিবর্তন ও বৈচিত্র্য আনয়ন।
(প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-২৩)
বাঙালির সংস্কৃতিতে মুসলমানের অংশ
বিশিষ্ট ভাষাসৈনিক, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী মাহবুব আনাম বাঙালি সংস্কৃতিতে মুসলমানের অংশ নির্ধারণ করে বলেন, ‘পশ্চিমবঙ্গ যেটা, তাকে বঙ্গ বলা হতো। আসল বাংলা আমাদের এই পূর্ব বাংলা। এর ইতিহাস খুঁজলে দেখা যাবে, এই পূর্ব বাংলার ইতিহাস হচ্ছে বাংলাদেশের ইতিহাস। আমরা আজ একটা স্বাধীন জাতি। আমাদের যেমন নিজস্ব একটা ব্যক্তিত্ব আছে, সমষ্টিগতভাবেও তেমনি একটা সত্তা আছে। আমাদের যে মেজরিটি, সে মেজররিটি হচ্ছে বাঙালি মুসলমান। সেই সংস্কৃতিটাই আসল বাঙালি সংস্কৃতি।’ (আমাদের সংস্কৃতি : বিচার্য বিষয় ও চ্যালেঞ্জসমূহ, পৃষ্ঠা-২৫)
তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের যুব সম্প্রদায় ভাবছেন যে, বাঙালি বলতে এক বিশেষ সম্প্রদায়ের বিশেষ ভাবধারা, বিশেষ চলাফেরা, বিশেষ কাপড়-চোপড় বুঝি বাঙালি। এটা কিন্তু তাদের একদম ভুল ধারণা। সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি হচ্ছে মুসলমান, আমাদের ধর্ম এবং আমাদের ঐতিহ্য—সব মিলেই আমাদের সংস্কৃতি এবং সেই সংস্কৃতিকে যদি আমরা এগিয়ে নিয়ে না যাই, তাহলে আমাদের মস্ত বড় ভুল হবে।’ (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-২৭)
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন