উন্নয়ন-সংস্কারের নামে হারিয়ে গেছে রাজশাহীর শহীদ এ এইচ এম কামারুজ্জামান কেন্দ্রীয় উদ্যান ও চিড়িয়াখানা। এখন নামও বদলে গেছে। ৫ আগস্টের পর নাম বদলে হয়েছে রাজশাহী কেন্দ্রীয় উদ্যান। সংস্কারের নামে তৎকালীন মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন চিড়িয়াখানাটি ধ্বংস করে দিয়েছেন। সংস্কার চলাকালে কিছু পশুপাখি মারা যায়, কিছু বিক্রি করা হয়। আবার কিছু অনুদান হিসেবে বিভিন্ন ব্যক্তিকে দেওয়া হয়েছে। এরপর বন্ধ করে দেওয়া হয় চিড়িয়াখানা। চিড়িয়াখানার ভিতরে নির্মাণ করা হয়েছে নভোথিয়েটার ও রিসোর্ট।
নগরবাসীর বিনোদনের চাহিদা মেটাতে ব্রিটিশ আমলের ঘোড়দৌড়ের মাঠে ১৯৭২ সালে উদ্যান ও চিড়িয়াখানা নির্মাণের উদ্যোগ নেন তৎকালীন মন্ত্রী শহীদ এ এইচ এম কামারুজ্জামান ও জেলা প্রশাসক আবদুর রউফ। প্রায় ৩৩ একর জমিতে নির্মিত উদ্যানটি ১৯৯৬ সালে জেলা পরিষদ থেকে সিটি করপোরেশনে হস্তান্তর করা হয়। সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, চিড়িয়াখানায় একসময় বাঘ, সিংহসহ অনেক পশুপাখি ছিল। ১৯৯৭ সালের জুনে ঢাকা চিড়িয়াখানা থেকে ছয় বছর চার মাস বয়সের একটি বাঘ আনা হয়। ১২ বছর নিঃসঙ্গ জীবন কাটিয়ে ২০০৮ সালে বাঘটি মারা যায়। আগে চিড়িয়াখানায় একটি সিংহ ও একটি সিংহী ছিল। ২০১৩ সালে সিংহী মারা গেলে কয়েক মাস পর সিংহটিও মারা যায়। খালি খাঁচায় পেলিক্যান পাখিটি রাখা হয়েছিল।
সূত্র জানান, ভালুকের জন্য ছিল একসঙ্গে যুক্ত দুটি নতুন খাঁচা। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে অসুস্থ হয়ে ভালুকটি মারা যায়। বানর, গাধা ও হরিণের জন্য নতুন খাঁচা তৈরি করা হয়েছিল। সে হরিণগুলোও নেই। পশুপাখির মধ্যে স্বপ্নপুরী পার্কে অনুদান হিসেবে দুটি বেবুন, ১৩টি বানর, তিনটি হনুমান, একটি অজগর ও দুটি মদনটাক পাখি দেওয়া হয়েছে। একটি মায়াহরিণ স্বপ্নপুরী পার্ক কর্তৃপক্ষের কাছে বিক্রি করা হয়েছে।
চিড়িয়াখানার নথি থেকে জানা গেছে, গোদাগাড়ী উপজেলার কাঁকনহাটের ফজলুল হককে ১৮টি বানর দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে পাঁচটি অনুদান হিসেবে পেয়েছেন তিনি। চিড়িয়াখানায় একটি ময়ূর ছিল। বাচ্চা হওয়ার পর মা ময়ূরটি মারা যায়। বাচ্চাটি বড় হয়েছিল। সেটি ফজলুল হকের কাছে বিক্রি করা হয়েছে। দুটি গাধা তাঁর কাছেই বিক্রি করা হয়েছে। অনুদান হিসেবে পেয়েছেন পেলিক্যান পাখিটি। সিদ্দিকী তাঞ্জিলুর রহমান নামে একজনের কাছে তিনটি গাধা, মারুফ কবিরের কাছে ১৮টি রাজহাঁস, খাজা আলমের কাছে ২০টি বাজিকর ও লাভবার্ড বিক্রি করা হয়। চিড়িয়াখানার একমাত্র ময়না পাখিটি অনুদান হিসেবে পেয়েছেন খায়রুজ্জামান লিটনের বাড়ির কর্মচারী অজু। দুটি ঈগলের একটি অনুদানে পেয়েছেন নোবেল আর একটি ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। শামসুল, নোবেল, ইসমাইল, জয়া ও কৃষ্ণ নামে কয়েক ব্যক্তি অনুদান হিসেবে ১৪টি খরগোশ পেয়েছেন। চারটি টিয়া, দুটি বনবিড়াল ও একটি গন্ধগোকুল প্রকৃতিতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। নয়টি কচ্ছপ লেকে অবমুক্ত করা হয়।
চিড়িয়াখানা আধুনিকায়নে ২০১০ সালে একটি প্রকল্প নেয় সিটি করপোরেশন। ওই সময় কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে চিড়িয়াখানার ভিতরে ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ শুরু হয়। চিড়িয়াখানা চত্বরের ভিতরে প্রায় ৭০ লাখ টাকা ব্যয়ে ‘অরণ্য রিসোর্ট’ নির্মাণ করা হয়েছে। ২২২ কোটি ৩ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে নভোথিয়েটার। এ ছাড়া পার্কের ভিতরে প্রায় ১৬ কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ হয়েছে। সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) রাজশাহী জেলা সভাপতি আহমদ সফিউদ্দিন বলেন, ‘চিড়িয়াখানাটি ধ্বংস করে একটা কংক্রিটের স্থাপনা বানানো হয়েছে; যা চিড়িয়াখানার ধারণার সঙ্গে একেবারেই যায় না। উন্নয়ন-সংস্কারের নামে নীরবে প্রতিষ্ঠানটি ধ্বংস করা হয়েছে।’