আব্দুস সালাম (৬০) রবিবার সন্ধ্যায় গোলাপগঞ্জের বৈটিকর বাজারে নিজের দোকানের তালা বদলাতে গিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি জানতেন না- বাড়ি থেকে এ যাওয়াই তার শেষ যাওয়া, ফিরে আসতে হবে গুলিবিদ্ধের অসংখ্য চিহ্ন নিয়ে- নিথর দেহে। স্ত্রী-সন্তানের আহাজারিতে এখন তার বাড়ির পরিবেশ ভারি।
বাজারে ঢুকার কিছুক্ষণ পরেই সংঘর্ষ ও গুলির মুখে পড়েন সালাম। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার ফুলবাড়ি ইউনিয়নের বৈটিকর বাজারে রবিবার নির্বাচনী সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন উপজেলার লক্ষ্মীপাশা ইউনিয়নের রামপা গ্রামের আবদুস সালাম। তিনি ওই বাজারে সাইকেল ও রিকশা মেরামতের একটি দোকান চালাতেন। প্রায় ২৫ বছর ধরে ওই দোকানের সামনে বসেই তিনি মেরামতকাজ করতেন।
চলমান ইউনয়ন পরিষদ নির্বাচনের চতুর্থ ধাপে রবিবার গোলাপগঞ্জ উপজেলায় ১০টি ইউনিয়নে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে একটি ছিলো ফুলবাড়ি ইউনিয়ন। বিকাল ৪টায় ভোট গণনা শেষে রাত ৮টার দিকে ৮ ও ৯নং ওয়ার্ডের কেন্দ্রের ফলাফলকে কেন্দ্র করে চেয়ারম্যান প্রার্থী জামায়াত নেতা এমরান হোসেনের সর্থকরা বৈটিকর বাজারে এসে সিলেট-জকিগঞ্জ সড়ক অবরোধ করেন। এসময় থানা পুলিশ এসে তাদের সড়কে থেকে সরিয়ে দিতে চাইলে পুলিশের সঙ্গে এমরান হোসেনের সমর্থকদের তুমুল সংঘর্ষ বাধে। এসময় পুলিশ টিয়ার সেল ও গুলি নিক্ষেপ করে। বৈটিকরের মসজিদের মাইকে এসময় ঘোষণা করে যার যা আছে তাই নিয়ে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়াতে বলা হয়।
সংঘর্ষকালে আবদুস সালাম গুরুতর আহত হন। পরে তাকে উদ্ধার করে ওসমানী হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত ডাক্তার মৃত ঘোষণা করেন। নিহত সালামের বুক ও পেটসহ সারা শরীরে ছররা গুলির অসংখ্য চিহ্ন দেখা গেছে।
সালামের ছেলে আবুল কালাম (২৬) জানান, তার বাবা রবিবার বিকাল ৪টার দিকে নিজ কেন্দ্রে ভোট দিয়ে বৈটিকরের দোকানের তালা বদলাতে যান। সে সময় তিনি বাড়িতে বলেন- দোকানের তালাটি মজবুত নয়, সেটি বদলাতে বাজারে (বৈটিকর) যাচ্ছেন।
পরে রাত ৮টার দিকে সালামের পরিবারের সদস্যরা এক প্রতিবেশীর মাধ্যমে তার গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর পান। খবর পাওয়ার পরপরই তার ছেলে আবুল কালামসহ কয়েকজন বৈটিকর বাজারে গিয়ে একটি মুদি দোকান থেকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় সালামকে উদ্ধার করে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। হাসপাতালে নেওয়ার পর রাত সাড়ে ১০টার দিকে দায়িত্বরত চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সালামকে মৃত ঘোষণা করেন।
আবুল কালাম আরও বলেন, ‘বাবা কার গুলিতে নিহত হয়েছেন, সেটি বলতে পারছি না। গতকাল রবিবার রাতে যখন তাকে উদ্ধার করা হয়েছিল, তখন তিনি কথা বলতে পারছিলেন না। বাবার দোকানের পাশের মুদি দোকানদার শাটার খুলে ভেতর থেকে বাবাকে আমাদের কাছে তুলে দেন। মুদি দোকানটি বাবার দোকানের পাশাপাশি ছিল। সে সময় বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি ছিল। পুলিশ বারবারই ঘটনাস্থলে যেতে আমাদের বাধা দিচ্ছিল, এরপরও বাবা গুলিবিদ্ধ হওয়ায় পুলিশের বাধা উপেক্ষা করেই তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম।’
নিহত সালামের ভাই আলাউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘দোকানে তালা বদলাতে গেলেও সম্ভবত রিকশা ও বাইসাইকেল মেরামত কাজ শুরু করেছিলেন তিনি। রাতে সংঘর্ষ বাধলে তিনি গুলিবিদ্ধ হন। গ্রামের এক বাসিন্দার মাধ্যমে আমি ভাইয়ের গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর পাই।’
এদিকে, ময়নাতদন্ত শেষে সোমবার (২৭ ডিসেম্বর) বেলা আড়াইটার দিকে সালামের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে পুলিশ। বিকালে তার দাফন সম্পন্ন হয়।
বিষয়টি সোমবার সন্ধ্যায় নিশ্চিত করেন গোলাপগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হারুনুর রশিদ চৌধুরী।
তিনি বলেন, ফুলবাড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান প্রার্থী ছিলেন জামায়াত নেতা এমরান হোসেন। নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর পরই তিনি জামায়াতের নেতাকর্মীদের নিয়ে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন।
খবর পেয়ে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে জামায়াতের নেতাকর্মীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি ছুঁড়ে। এসময় জামায়াতের নেতাকর্মীদের ছুঁড়া গুলিতে আব্দুস সালাম গুরুতর আহত হন। তাকে উদ্ধার করে ওসমানী হাসপাতালে পাঠানো হলে চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য আহত হন। এ ঘটনায় থানায় মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে।
সংঘর্ষের সময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে পুলিশ ২৬৭ রাউন্ড শর্টগানের গুলি ছুঁড়েছে।
বিডি প্রতিদিন/আরাফাত