বরিশাল জেলার ৬টি আসনে ব্যাপক ভরাডুবির ঘটনায় মানসিকভাবে বিধ্বস্ত বিএনপির নেতা-কর্মীরা। নির্বাচনের মাঠে কোনোভাবেই দাঁড়াতে না পেরে হতাশ এই দলটির সিনিয়র নেতা থেকে তৃনমূলের কর্মীরাও। আগামী দিনগুলোতে কিভাবে তারা কোমড় সোজা করে দাঁড়াবেন সেই পথ খুঁজছেন তারা।
রবিবার (৩০ডিসেম্বর) অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বরিশাল জেলার ৬টি আসনেই বিজয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগ তথা মহাজোটের শরীক জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা। এরমধ্যে ৫টিতে বরিশাল-১ আসনে আওয়ামী লীগের আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ, বরিশাল-২ আসনে আওয়ামী লীগের মো. শাহে আলম, বরিশাল-৪ আসনে পংকজ নাথ, বরিশাল-৫ আসনে কর্নেল (অব.) জাহিদ ফারুক শামীম এবং বরিশাল-৬ আসনে নিরঙ্কুশ বিজয় হয়েছেন জাতীয় পার্টির নাসরিন জাহান রত্না আমীনের। শুধুমাত্র বরিশাল-৩ আসনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়েছে জাতীয় পার্টি আর বিএনপি প্রার্থীর মধ্যে। এখানে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির এ্যাড. জয়নাল আবেদীনকে ৭ হাজার ৪৯১ ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে ৫৪ হাজার ৭৭৮ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন জাতীয় পার্টির গোলাম কিবরিয়া টিপু।
বরিশাল মহানগর বিএনপির সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম মহাসচিব এ্যাড. মজিবর রহমান সরোয়ার বলেন, আওয়ামী লীগ পুলিশের সহায়তায় জবরদস্তি করে জনগণের ভোট কেড়ে নিয়েছে। দলীয় সরকারের অধিনে ভোট ডাকাতির কারণে আগামী দিনে এর চরম মাশুল গুনতে হবে আওয়ামী লীগকে। আগামীতে নির্দলীয় সরকারের অধীনে ছাড়া এ দেশে কোনো নির্বাচন হবে না এবং বিএনপিও কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না বলে তিনি জানান।
প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের হাসানাত আবদুল্লাহর কাছে ২ লাখ ৪ হাজার ১৯৭ ভোটে হেরে ওই রাতেই পুলিশের পাহাড়ায় নির্বাচনী এলাকা ত্যাগ করেন বরিশাল-১ আসনে বিএনপির পরাজিত প্রার্থী জহিরউদ্দিন স্বপন। রাতে বরিশাল নগরীতে অবস্থান করে পর দিন ঢাকার উদ্দেশে বিমানে বরিশাল ত্যাগ করেন তিনি।
ওই আসনের গৌরনদী উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক বদিউজ্জামান মিন্টু বলেন, শুধুমাত্র পুলিশের কারণে ভোটের মাঠে দাঁড়াতে পারেনি বিএনপি। নির্বাচন পরবর্তী সময়ে এখন তারা নির্বিঘ্নে বাড়ি ফিরতে পারবেন কিনা বা তাদের ভাগ্যে কি অপেক্ষা করছে কিছুই বুঝতে পারছেন না তারা।
বরিশাল-২ আসনে বিএনপির পরাজিত প্রার্থী সরদার সরফুদ্দিন আহমেদ সান্টু নির্বাচিত এলাকা ছেড়েছেন নির্বাচনে তিন দিন আগে। নির্বাচনের আগে-পরে নেতাকে না পেয়ে নিরাশ বিএনপির স্থানীয় নেতা-কর্মীরা।
উজিরপুর উপজেলা বিএনপির কৃষি বিষয়ক সম্পাদক শফিউল আলম সফরুল জানান, নির্বাচনের সময় নেতা-কর্মীরা একাধিক মামলার শিকার হয়েছেন। তাদের প্রার্থী নির্বাচনের তিন দিন আগে এলাকা ছাড়লেও তারা তৃনমূলের নেতা-কর্মীরা কি করবেন সেরকম কোনো দিক নির্দেশনা দেননি তিনি। এমনকি তাদের প্রার্থীর সাথে তৃনমূলের কোনো নেতা-কর্মীদের যোগাযোগও নেই।
বরিশাল-৩ আসনের বিএনপি প্রার্থী এ্যাড. জয়নুল আবেদীন নির্বাচনী এলাকা ত্যাগ করেন নির্বাচনের পর দিন সোমবার সকালে। যাওয়ার আগে জয়নুল আবেদীন নেতা-কর্মীদের মনোবল নিয়ে এলাকায় অবস্থান এবং কোনো ধরনের ঝামেলায় না জড়ানোর নির্দেশনা দেন বলে জানান ওই আসনের বাবুগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সহ-সভাপতি কামরুল আহসান হিমু।
বরিশাল-৪ আসনের ঐক্যফ্রন্ট প্রার্থী নাগরিক ঐক্যের জেএম নুরুর রহমান জাহাঙ্গীরকে ভোটের দিনও নির্বাচনী এলাকায় দেখেননি কেউ। ভোটের দিন দুপুরে বরিশাল নগরীতে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেওয়ার পর থেকে নিরুদ্দেশ তিনি। এই আসনের নির্বাচনে নুরুর রহমানের পক্ষে কাজ করা বিএনপির তৃনমূল নেতা-কর্মীরা এখন দিশেহারা।
বরিশাল-৫ (সদর) আসনে পরাজিত বিএনপি প্রার্থী এ্যাড. মজিবর রহমান নির্বাচনের আগে থেকেই অবস্থান করছেন বরিশাল নগরীতে। নির্বাচনের আগে পরের কয়েক দিন তার বাসার চারপাশে ব্যাপক পুলিশ বেষ্টনীর কারণে নেতা-কর্মীরাও যেতে পারেননি তার বাসায়। তবে নির্বাচনের পরদিন সকাল ১১টার পর তার বাসার সামনে থেকে পুলিশ প্রত্যাহারের পর থেকে কিছু নেতা-কর্মীর পদচারণা পড়ছে সরোয়ারের বাসায়। কিন্তু প্রকাশ্য রাজপথে দেখা যাচ্ছে না তাদের।
মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক জিয়াউদ্দিন সিকদার জিয়া বলেন, নির্বাচনের আগে একাধিক গায়েবি মামলায় বিএনপির কয়েক শ’ নেতা-কর্মীকে আসামি করা হয়েছে। পুলিশের গ্রেফতার এড়াতে তারা এখনও আত্মগোপনে। আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি নতুনভাবে সংগঠন শক্তিশালী করতে কর্মসূচি আসছে বলে তিনি জানান।
বরিশাল-৬ আসনে পরাজিত বিএনপি প্রার্থী আবুল হোসেন খান নির্বাচন প্রাক্কালে গ্রেফতার হওয়া তার ৩৬ নেতা-কর্মীর সাথে গত সোমবার সকালে সাক্ষাৎ করেন বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারে। ওই আসনের অন্যান্য নেতা-কর্মীরাও গভীর সংকটে নিমজ্জিত।
তবে এই আসনে পরাজিত বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য আবুল হোসেন খান বলেন, ভোটের আগের রাতেই সারা দেশে একই ডিজাইনে একই প্লানে ভোট হয়ে গেছে। পরদিন ৩০ ডিসেম্বর সকাল ৮টায় ভোট শুরুর আগেই বিএনপির এই নির্বাচন থেকে সরে যাওয়া উচিৎ ছিল বলে মনে করেন এই সাবেক এমপি। তিনি বলেন, রাষ্ট্র যখন সন্ত্রাসী হয়, রাষ্ট্র যন্ত্র যখন প্রতারণা করে তখন জনগণের কি করার আছে। বিএনপির নেতা-কর্মীরা একটুও মনোবল হারায়নি এবং সাংগঠনিকভাবে তারা অনেক শক্তিশালী দাবি করে আবুল হোসেন বলেন, বিএনপির ভারডুবি হয়নি, আওয়ামী লীগের অপকৌশলের কাছে দেশের মানুষের ভরাডুবি হয়েছে। দেশের জনগণ এই অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়াবে বলে বিশ্বাস তাদের।
বিডি-প্রতিদিন/বাজিত হোসেন