মহান বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে গত ১৬ ডিসেম্বর ধানমণ্ডি ৩২-এ জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানানোর সময় যুব মহিলা লীগের নেত্রীদের মধ্যে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। এতে চুলোচুলি ছাড়াও কয়েকজন নেত্রী আহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। এরই জের ধরে যুব মহিলা লীগ ঢাকা মহানগর উত্তরের সভাপতি ও সংরক্ষিত আসনের সাবেক এমপি সাবিনা আকতার তুহিনকে শোকজ করেছেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি নাজমা আকতার। আর শোকজ করা নিয়ে সংগঠনের ভেতরে মিশ্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে। নানা রকম প্রশ্ন তুলেছেন সংগঠনের নেত্রীরা।
সংগঠনের নেত্রীরা প্রশ্ন তুলেছেন, কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে বৈঠক করে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক যৌথ স্বাক্ষরে শোকজ করার নিয়ম প্রচলিত আছে। এছাড়াও তুহিনের শোকজে যেসব কারণ দেখানো হয়েছে-তাতে অনুমান হয়, সভাপতি নাজমা তার পূর্ব আক্রোশের প্রতিশোধ হিসেবেই ধানমণ্ডির ঘটনাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছেন। কারণ ওই ঘটনায় যুব মহিলা লীগের অন্য নেত্রীরা গাছের ডাল ভেঙে সংগঠনের নেত্রীদের পিটানো, কাপড় ধরে টানাহেঁচড়া করলেও তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। কারণ হিসেবে যুব মহিলা লীগের নেত্রীরা বলছেন, যারা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত তারা অধিকাংশই নাজমা গ্রুপের। আর সামনে যুব মহিলা লীগের সম্মেলন।
সাবিনা আক্তার তুহিন ছোটবেলা থেকেই মাঠের রাজনীতিতে অভ্যস্ত। দলের দুর্দিনে রাজপথে থেকে অত্যাচার সহ্য করেছেন, সন্তান প্রসবে সিজার করা অবস্থায় ১৮ দিনের মাথায় বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে আন্দোলনে মাঠে ছিলেন। পুলিশের লাত্থিতে তার সেলাই কেটে যায়। পরে ওই অবস্থায় গ্রেফতার করা হয়। ১৮ দিনের শিশুকে রেখে বুকের দুধ পান করাতে পারেননি। পরীক্ষিত এই নেত্রীর আগামী দিনে সংগঠনটির বড় পদে আসার পথ বন্ধ করতেই এমন আচরণ করছেন সংগঠনটির সভাপতি নাজমা আক্তার। সাধারণ সম্পাদক অপু উকিল এই শোকজে একমত না হওয়ায় তার স্বাক্ষর ছাড়াই চিঠি দেওয়া হয়েছে। তবে এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত গণমাধ্যমে বা ফেসবুকে কোনো মন্তব্য করেননি অপু উকিল। অপু উকিলের মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সাড়া মেলেনি।
গত মঙ্গলবার বিকালে দেওয়া শোকজ নোটিশে বিভিন্ন সময়ের চারটি ঘটনা অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এরমধ্যে ‘ধানিণ্ডির ঐতিহাসিক ৩২ নম্বরে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদনের সময় অসাংগঠনিক কর্মকাণ্ড করেছেন। এছাড়া ২০১৭ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পর থানা ও ওয়ার্ডের কমিটি সম্মেলন না করা, নরসিংদীর ‘বিতর্কিত’ নেত্রী পাপিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্ব এবং ফেসবুকে নাজমা আক্তারকে নিয়ে পোস্ট করার কথা শোকজ লেটারে উল্লেখ করা হয়।’
কেন্দ্রীয় ও মহানগর যুব মহিলা লীগের দুই ডজন নেত্রী জানিয়েছেন, সামনে সম্মেলনকে সামনে রেখে দলের দুর্দিনের কর্মীদের সাইজ করার মিশনে নেমেছেন কেউ কেউ। ঢাকা মহানগর উত্তর যুব মহিলা লীগ একটি শক্তিশালী সংগঠন। বিরোধী দলের সময় কিংবা সরকারি দলে অন্য সংগঠনের চেয়ে যুব মহিলা লীগ ঢাকা উত্তর সব সময় সরব উপস্থিতি। ১/১১ সময়েও উত্তরের নেত্রীরা সামনের সারিতে ছিল। পাপিয়া কাণ্ডের ঘটনা অনেক দিনের। সম্প্রতি ধানমণ্ডিতে ঘটে যাওয়ার ঘটনা নিয়ে যুব মহিলা লীগের সভাপতি নাজমা কেন ‘পাপিয়া’ কাণ্ডকে সামনে আনলেন তা কারোই বোধগম্য নয়। এছাড়াও পাপিয়া গ্রেফতারের পর রিমান্ডে যেসব তথ্য দিয়েছে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বরাত দিয়ে সেই তথ্যে পাপিয়ার পৃষ্টপোষক হিসেবে নাজমার নামই এসেছে। সে সময়ের গণমাধ্যমগুলো দেখলেই এ তথ্য পাওয়া যাবে। আর তুহিন যদি সত্যিই পাপিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতো, তাহলে কেন তার বিরুদ্ধে এত পরে চিঠি দেওয়া হলো? এতদিন পর নাজমার ঘুম ভেঙেছে? এতোদিন কি কম্ভু ঘুমে ছিলেন নাজমা আকতার? দুর্দিনের কর্মীদের সাইজ করার মিশনে দলই বিব্রত হবে। ত্যাগীদের কোনঠাসা করে হাইব্রিড লালন-পালন করলে দুঃসময়ে তাদেরকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। সুগন্ধী মাখাদের দুর্দিনে পাওয়া যায় না। বরং আন্দোলনে যারা ঘাম ঝড়িয়েছে, তারাই আবার দুঃসয়ে সামনের সারিতে থাকবে।
শোকজের বিষয়ে সাবিনা আক্তার তুহিনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি এখনো চিঠি পাইনি। চিঠি পেলে বিস্তারিত বলবো। তবে সামনে যুব মহিলা লীগের সম্মেলন আছে। আমি প্রার্থী হতে পারি, এমন আশঙ্কা থেকে আমার বিরুদ্ধে নানামুখী ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে আমাকে শোকজ করা হয়েছে কিনা তা খোঁজ নিন। তবে সুবিধার জন্য আমি রাজনীতি করি না। আমি তুহিন ছোটবেলা থেকেই জাতির পিতার কন্যার সঙ্গে আন্দোলন-সংগ্রাম, মিছিল, মিটিংয়ে ছিলাম, আছি, থাকবো। পদ-পদবী আমার কাছে বড় নয়, বঙ্গবন্ধুকন্যার একজন কর্মী হয়ে থাকাই আমার কাছে বড়।’
এককভাবে শোকজের বিষয়ে নাজমা আক্তার গণমাধ্যমকে বলেছেন, সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক অপু উকিল ঢাকার বাইরে। আর গঠনতন্ত্রের ১২(খ) ধারা মোতাবেক ‘শাখা সংগঠনসমূহের সভাপতি দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে তিনি কার্যনির্বাহী কমিটি এবং ঊর্ধ্বতন সবস্তরে জবাবদিহি করবেন’ এবং গঠনতন্ত্রের ১১(খ) ধারা ‘সভাপতির গঠনতান্ত্রিক ক্ষমতা বা দায়িত্ব’ মোতাবেক এই শোকজ দেওয়া হয়েছে বলে আমি চিঠিতে উল্লেখ করেছি।
সেদিন কী ঘটেছিল?
গত ১৬ ডিসেম্বর মহানগর বিজয় দিবস ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতাকর্মী ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। প্রথমে আওয়ামী লীগ, পরে পর্যায়ক্রমে সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এর অংশ হিসেবে যুব মহিলা লীগও শ্রদ্ধা নিবেদন করতে যান। উপস্থিত সংগঠনের নেতাকর্মী ও স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব পালনকারী একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যুব মহিলা লীগের শ্রদ্ধা নিবেদনের সময় কিছু অপ্রতিকর ঘটনা ঘটে।
তারা বলছেন, জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য সাবিনা আকতার তুহিন যুব মহিলা ঢাকা উত্তরের নেত্রীদের নিয়ে প্রবেশ করে ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকেন। এরপর যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক অপু উকিল প্রবেশ করেন। এসময় পেছন থেকে ছেলেরা সামনের সারিতে যাওয়ার জন্য ধাক্কাধাক্কি শুরু করলে তুহিন সামনে যেতে বাধ্য হন। এরপর শ্রদ্ধা নিবেদন করতে যান। এমন সময় মাইকে তুহিনের লোকজনকে নিয়ে বের হয়ে যেতে বলেন স্বেচ্ছাসেবকগণ। পরে শ্রদ্ধা নিবেদনের সময় তুহিনকে লাত্থি মারেন যুব মহিলা লীগের সভাপতি নাজমা আকতার বলে দাবি তুহিনের। তুহিন আরও অভিযোগ করেন, নাজমা আমাকে লাত্থি মারা পাশাপাশি তার অনুসারী শারমীন সুলতানা লিলি, লাবনী, কানিস, রিমি ও সুমিসহ অনেক নেত্রীকে দিয়ে আমার কর্মীকে চরম মারপিট করেন। তিনি অভিযোগ করেন, ২০১৭ সালের পর যারা যুব মহিলা লীগে ঢুকেছে, তাদের কারণেই সংগঠনের ভাবমুর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে। নব্যরা সবাই সভাপতি নাজমা গ্রুপের সঙ্গেই ভিড়ে সংগঠনে বিশৃঙ্খলা করছে। লিলি যে নিজ সংগঠনের নেত্রীদের মারপিট করে, ২০১০ সালের পত্রপত্রিকায় এমন অসংখ্য ছবি ছাপা হয়েছে। ওই দিন কী ঘটেছিল ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে। এ বিষয়ে এ প্রতিবেদকের কথা হয় গত ১৭ ডিসেম্বর। সেই সময় যুব মহিলা লীগের নেত্রীরা যা জানিয়েছিলেন তা তুলে ধরা হলো।
ওই দিন কী ঘটেছিল ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে। এ বিষয়ে এ প্রতিবেদকের কথা হয় গত ১৭ ডিসেম্বর। সেই সময় যুব মহিলা লীগের নেত্রীরা যা জানিয়েছিলেন তা তুলে ধরা হলো।
ঢাকা মহানগর উত্তর যুব মহিলা লীগের সভাপতি সাবিনা আকতার তুহিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ফুল দেওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনে যাই। এসময় পেছন থেকে ধাক্কায় সামনে গিয়ে যুব মহিলা লীগের সভাপতি নাজমা আপা ও অপু উকিল দিদির জন্য অপেক্ষা করছিলাম। এসময় লোকের ভিড় বাড়তে থাকায় আমার নাম মাইকে ঘোষণা করা হয়। এরপর কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের জন্য অপেক্ষা করি। সাধারণ সম্পাদক অপু দি কে আগে দেখতে পাই। এরপর নাজমা আপা আসেন। ভিড়ের ভেতরে আমিও বেদির কাছে যাই। এমন সময় নাজমা আপাকে আমাকে বের হয়ে যেতে বলেন। আমি আপাকে বললাম, ভিড়ের কারণে বের হতে পারছি না। আমি চলে যাবো। এমন সময় নাজমা আমাকে তিন দফায় লাত্থি মারে। পরে সে ফুল না দিয়েই বের আসেন। আমরা ফুল বের হয়ে আসার সময় শারমিন সুলতানা লিলি, লাবনীসহ অনেকেই গাছের লাঠি নিয়ে আমার মেয়েদের মারপিট করে। এতে মিরপুর থানা সভাপতি ফেন্সি আহমেদ, তেজগাঁয়ের বিথী, ঢাকা মহানগর উত্তর সদস্য দোলা, রুপনগর সভাপতি সিমা, শাহ্আলী থানার সভাপতি শামসুন নাহার, পল্লবী থানার সভাপতি পলিসহ ১২/১৫ মেয়েকে বেদম প্রহার করেছে। যা ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে থাকা সিসিটিভি দেখলেই সত্যতা পাওয়া যাবে। জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদনের সময় এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে এটা কোনভাবেই কাম্য নয়।
তিনি বলেন, আসলে সামনে যুব মহিলা লীগের সম্মেলন উপলক্ষে আমাকে হেয়পতিপন্ন করতেই এমন ঘটনা ঘটানো হয়েছে। কেউ কেউ ভাবেন, যদি সামনে আমি প্রার্থী হই? দলের চরম দুঃসময়ের অবদানের কারণে যদি নেত্রী আমাকে মুল্যায়ন করেন সেই কারণে আমাকে বির্তকিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে।’
যুব মহিলা লীগের সভাপতি নাজমা আকতার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে তুহিন যে বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে তা লজ্জাকর। আধাঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে ওর কারণে মাল্যদান করতে পারিনি। প্রতিটি প্রোগ্রামেই তুহিন এমন পরিবেশ সৃষ্টি করে। যে কোন দিবসে আগে আওয়ামী লীগ, পরে মূল সহযোগী সংগঠন, এরপর ঢাকা মহানগর ও জেলা শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। কিন্তু তুহিন প্রতিবারই নিয়ম ভঙ্গ করে আগেই শ্রদ্ধা জানান। সেদিনের ঘটনা থেকে নিজেকে বাঁচাতে আমার উপর দোষারোপ করছে। আমি কেন তুহিনকে লাত্থি মারতে যাবে? আমি তো ওর সর্ম্পকে ভালো করে জানি। তুহিনের মেয়েরাই লিলি, রিমি, দুলিকে মেরেছে।
সাংগঠনিক সম্পাদক শারমিন সুলতানা লিলি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সাবিনা আকতার তুহিন আপা যুব মহিলা লীগের সভাপতি নাজমা আপার সাথে চরম খারাপ আচরণ করেছে সেদিন। সে কারণে বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটেছে। আমরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু জাদুঘরের সামনে দাঁড়িয়েছিলাম। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদকের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। এরমধ্যে মাইকে বার বার ঘোষণা শুনতে পাই, ‘তুহিন আপনার ফুল দেওয়া হয়েছে, আপনি আপনার মেয়েদের নিয়ে চলে যান।’ কিন্তু তুহিন আপা তা করেননি। বেদির সামনে জায়গা দখল করে রেখে নাজমা আপাকে ঢুকতে দেয়নি। ফলে নাজমা আপা ফুল না দিয়ে রাগ করে চলে আসে। এরপর আমরা সবাই পাশে দাঁড়াই। এসময় তুহিন আপা, নাজমা আপার সামনে এসে আঙ্গুল করে কথা বলে। এটা তো বেয়াদবি। তুহিন আপার মেয়েরা আমাকে গলায় ওড়না দিয়ে পেচিয়ে ধরে, দুলি ও রিমি আপাকে প্রহার করে। ঘটনা এটুকুই।’
‘আপনি গাছের ডাল ভেঙে তুহিন গ্রুপের মেয়েদের মেরেছেন-এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে লিলি বলেন, কথার কথা যদি মারতে যাইও তাহলে কেন মারতে গেলাম? তাদেরকে জিজ্ঞেস করুন? আমার আর বেশি কিছু বলার নেই।’
বিডি প্রতিদিন/আরাফাত