বরিশালে মাদক সেবনসহ লঘু অপরাধে প্রথমবার সাজাপ্রাপ্ত ২৬৫ জনকে মা-বাবার সেবা ও সামাজিক কর্মকাণ্ড করার শর্তে প্রবেশনে মুক্তি দিয়েছেন আদালত। আদালতের শর্ত প্রতিপালন করে এখন পর্যন্ত ৭০ জন পুরোপুরি মুক্ত হয়েছে। প্রবেশন পাওয়ায় সামাজিক মর্যাদা অক্ষুণ্ন থাকার পাশাপাশি নিজের ভুল শুধরে নতুন করে ঘুরে দাঁড়িয়েছে তারা। এতে খুশি তাদের পরিবার ও প্রতিবেশীরা। প্রবেশন পাওয়া অন্যদেরও সংশোধন করার চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন সমাজসেবা কর্মকর্তারা। লঘু অপরাধীদের প্রবেশনে মুক্তি দেওয়া আদালতের যুগান্তকারী পদক্ষেপ বলে জানিয়েছেন আইন বিশেষজ্ঞরা।
বরিশাল নগরীর নথুল্লাবাদ লুৎফর রহমান সরকারের বাসিন্দা মহিউদ্দিন ডাকুয়া একটি বেসরকারি কোম্পানির ডেলিভারি ভ্যান চালিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। প্রায় ১ বছর আগে এক পুড়িয়া গাঁজার মামলায় তাকে ৬ মাসের কারাদণ্ডের আদেশ দেন আদালত। পরিবারে মহিউদ্দিন ছাড়া আয় করার কেউ নেই। মহিউদ্দিন প্রথমবারের মতো লঘু অপরাধ করায় তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২১ দিন দণ্ডভোগ করার পর মানবিক আদালত তাকে বাবা-মায়ের সেবা, নিয়মিত নামাজ আদায় এবং কৃষি কাজ করার শর্তে প্রবেশন অ্যাক্ট-১৯৬৪ এর ৫ ধারা অনুসারে সমাজ সেবা কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে প্রবেশনে মুক্তি দেয়।
আদালতের আদেশ প্রতিপালন করে এখন পুরোপুরি মুক্তির দ্বারপ্রান্তে মহিউদ্দিন। দণ্ড হওয়ার পরও কারাগারে না গিয়ে বাসায় থেকে সমাজ উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়ায় এলাকায় ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ন তার। জীবিকা করে পরিবার-পরিজনের মুখে অন্ন সংস্থান করছেন তিনি। সংশোধন হওয়ার সুযোগ দেয়ায় আদালতের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তিনি।
তার মতো বাকেরগঞ্জের যুবক মো. মিরাজেরও এক পুড়িয়া গাঁজা মামলায় ৬ মাসের কারাদণ্ড হয়। প্রথমবারের মতো অপরাধ করায় দোষ স্বীকার করে দায় থেকে মুক্ত হলে প্রবাসে থাকা স্ত্রীর কাছে চলে যাওয়ার অঙ্গীকার করে আদালতে আবেদন করেন মিরাজ। সপ্তাহে ৪ দিন মসজিদ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা, বাবা-মায়ের সেবা করা, ভালো কাজ করা এবং মাদকের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালানোর শর্তে ১২ দিন কারাভোগের পর প্রবেশনে মুক্তি পায় সে। মহিউদ্দিন ও মিরাজের মতো নানা লঘু অপরাধে দণ্ডপ্রাপ্ত ২৬৫ জনকে এভাবে প্রবেশনে মুক্তি দিয়েছেন বরিশালের আদালত। আদালতের সুযোগ লুফে নিয়ে অতীত ভুল শুধরে জীবনের গতি পাল্টে ফেলেছেন তাদের অনেকে।
দণ্ডপ্রাপ্ত হয়েও বাসায় থেকে বাবা মায়ের সেবা এবং সামাজিক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড করায় তাদের প্রশংসা করেছেন প্রতিবেশীরাও। সুযোগ পেয়ে সুস্থ জীবনে ফিরে আসায় তাদের আচরণে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন তারা। প্রবেশন পাওয়া ব্যক্তিদের সার্বিক কার্যক্রম নজরদারি করার জন্য জেলা সমাজ সেবা কার্যালয়ের প্রবেশন কর্মকর্তাকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের প্রবেশন কর্মকর্তা সাজ্জাদ পারভেজ বলেন, প্রথমবার লঘু অপরাধ করেছেন বরিশাল জেলায় এমন ২৬৫ জনকে সমাজ উন্নয়ন ও সামাজিক কর্মকাণ্ড করার শর্তে প্রবেশনে মুক্তি দিয়েছেন আদালত। তাদের কার্যক্রম নিয়মিত নজরদারি করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে আদালতের শর্ত প্রতিপালন করে জেলায় ৭০ জন পুরোপুরি মুক্ত হয়েছে। তাদের জীবনের গতিপথ পাল্টে গেছে। অন্যদের মধ্যে আরও কয়েকজন পুরোপুরি মুক্তির অপেক্ষায়। কেউ শর্ত ভঙ্গ করলে তাদের আদালতে রিপোর্ট দেয়া হয়। তখন প্রবেশন বাতিল করে ফের তাদের কারাগারে পাঠানো হয়।
প্রথমবার লঘু অপরাধীদের প্রবেশনের মাধ্যমে মুক্ত জীবনে সংশোধন হওয়ার সুযোগ দেয়া আদালতের একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ বলে মনে করেন বরিশাল জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সাবেক আইন কর্মকর্তা (পিপি) ও জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট একেএম জাহাঙ্গীর।
তিনি বলেন, লঘু অপরাধীরা একই কারাগারে দাগি আসামিদের সাথে থাকলে তাদেরও ভয়ঙ্কর অপরাধী হয়ে ওঠার আশঙ্কা থাকে। কারাগারে থাকা অন্য লঘু অপরাধীদের সংশোধনের সুযোগ দেয়া হলে তারাও আলোর পথে ফিরে আসবে প্রত্যাশা তার।
বিডি প্রতিদিন/এমআই