বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডীয়ান চলচ্চিত্র নির্মাতা নাদিম ইকবাল এবার হলিউডে সম্মানিত হতে যাচ্ছেন। তার নির্মিত ডকুমেন্টারি চলচ্চিত্র ‘মাদার টাং’ আন্তর্জাতিক বিনোদনের রাজধানী হিসেবে খ্যাত হলিউড থেকে দুটো পুরষ্কার ছিনিয়ে নিয়েছে। ১০ ডিসেম্বর হলিউড স্টুডিওতে চলচ্চিত্র বোদ্ধাদের সামনে ‘মাদার টাং’ ডকু ফিল্মটি প্রদর্শিত হবে। একই সময়ে নাদিম ইকবালের হাতে তুলে দেয়া হবে হলিউড ইন্টারন্যাশনাল ইনডেপেন্ডেন্ট অ্যাওয়ার্ড।
এদিকে হলিউডভিত্তিক ‘ফেমাস ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’ এ প্লাটিনাম এওয়ার্ড পেয়েছে নাদিম ইকবালের ডকু ফিল্ম ‘মাদার টাং’। ফেস্টিভ্যালে ডকু ফিল্মটি প্রদর্শিত হবে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে চিত্র নির্মাতার হাতে পুরষ্কার তুলে দেওয়া হবে। ব্যতিক্রমী বিষয়বস্তু আর নির্মাণশৈলীর বিবেচনায় চলচ্চিত্রের বছরের সেরাদের নিয়ে আয়োজিত হয় ‘ফেমাস ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’। ২০১৬ সালের সেরাদের মধ্যে সেরা তালিকায় স্থান করে নিয়েছে নাদিম ইকবালের ‘মাদার টাং’।
ফটোগ্রাফি ও চলচ্চিত্র নির্মাণে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রশিক্ষিত নাদিম ইকবালের প্রথম ছবি ‘মাদার টাং’। সাড়ে ১১ মিনিট দৈর্ঘের এই ছবিতে তিনি ফটোগ্রাফি ও চলচ্চিত্র নির্মাণে বেশ মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। শাদা চোখে আটপৌরে কাহিনীর মতো মনে হলেও উপস্থান আর নির্মাণশৈলীর বিশেষত্বে ‘মাদার টাং’ ডকু ফিল্মটি হয়ে ওঠেছে বিশেষ একটি চলচ্চিত্র।
টরন্টোর মূলধারার আয়োজনে প্রথমবার প্রদর্শিত হওয়ার পরই চলচ্চিত্রবোদ্ধাদের নজর কাড়ে নাদিম ইকবালের ‘মাদার টাং’। সবাই আগ্রহী হয়ে ওঠেন চলচ্চিত্রটি নিয়ে। সেখান থেকে নাদিমের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে আন্তর্জাতিক মহলেও। গত মাসেই ডেনভারের একটি চলচ্চিত্র উৎসবে আমন্ত্রিত হয়ে যোগ দেন নাদিম ইকবাল। সারা বিশ্ব থেকে সমবেত হওয়া ৫৫ হাজার সিনেমা পাগল দর্শকদের নিয়ে ওই আয়োজনে বিশ্বের নামি দামি ১৫০জন চলচ্চিত্র নির্মাতা অংশ নেন। প্রদর্শনীর পাশাপাশি সেখানে নিজের ছবি নিয়ে কথা বলতে হয় নাদিমকে।
‘মাদার টাং’ এর কাহিনীর কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন একজন প্রৌঢ়- যিনি বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান কবি। একদা বাংলা ভাষার জন্য লড়াইয়ে নেমেছিলেন, সেই লড়াইয়ের রেশ ধরেই স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম। সেই কবির পরের প্রজন্ম হয়েছে প্রবাসী। বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া কিন্তু প্রবাসে বেড়ে ওঠা নাতনীকে ঘিরে ভাষা আর সংস্কৃতির সংযোগের সূত্রটি ছিড়ে যাওয়ার আশংকাজনিত বেদনাবোধ নিয়েই বিস্তৃত হয়েছে ‘মাদার টাং’ ডকু ফিল্মটির কাহিনী বিন্যাস।
কবি নিজে বাংলা ভাষার প্রধান একজন কবি, অথচ তারই উত্তরসূরী বেড়ে ওঠছে ভিন্ন ভাষায়। যাদের কাছে বাংলাটা কেবল দূরের ভাষাই নয়, দুর্বোধ্যও। এই দূরত্ব আর দুর্বোধ্যতার দেয়াল ডিঙিয়ে কবির নিজের লেখালেখি, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ভিন্ন সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা উত্তরসূরীকে স্পর্শ করবে কিভাবে? কবির এই বেদনাবোধ আসলে অভিবাসী সমাজের অমিমাংসিত অথচ গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। আর সেই প্রশ্নটিই ‘মাদার টাং’কে নিছক বাঙালি এক পরিবারের কাহিনী থেকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের জ্বলন্ত এক জিজ্ঞাসার রুপ দিয়েছে। বাংলা ভাষায় নির্মিত এই ডকু ফিল্মটি হয়েছে ইউরোপ আমেরিকার অভিবাসী সমাজের অবিচ্ছেদ্য এক দর্পণ।
নাদিম ইকবালের ‘মাদার টাং’ ইউরোপ আমেরিকার চলচ্চিত্রবোদ্ধাদের তুমুল আলোড়িত করলেও অন্তর্মূখী নাদিম ইকবাল যেনো ততোটাই নির্মোহ। ‘ছবি বানাতে ভালো লাগে, তাই ছবি বানাই’- এমন সাদামাটা প্রতিক্রিয়ায় নিজেকে গুটিয়ে রাখতে চান নাদিম। নাদিমের ভাষায়,'চোখের সামনে দেখা শোনা বিষয়কেই আমি চিত্রায়িত করার চেষ্টা করি, এর আর এমন বিশেষত্ব কি? নাদিমের কাছে ‘বিশেষ কিছু’ না হলেও তার ‘মাদার টাং’ পশ্চিমা সিনেমাবোদ্ধাদের নজর কেড়েছে। তারা একে বিশেষ কিছু হিসেবেই সম্মানিত করছেন। সেই সাথে সম্মানিত হচ্ছে লাল সবুজের বাংলাদেশও।
বিডি প্রতিদিন/৯ ডিসেম্বর, ২০১৬/ফারজানা