প্রয়াত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের ছোট পুত্র নিনিতের আজ জন্মদিন। তার জন্মদিনকে ঘিরে নানা স্মৃতি বিজড়িত কথা ফেসবুকে তুলে ধরেছেন হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন। ফেসবুক স্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে ধরা হলো:
নিনিত হবার সময় হুমায়ূন আহমেদের ধারণা হয়েছিল তাঁর কন্যা হবে। খুব শখ ছিল যমজ কন্যা সন্তানের। দেশের বাইরে বেড়াতে গিয়ে যমজ বাচ্চাদের double stroller দেখলেই কিনে ফেলতে চাইতেন। মেয়ে বাচ্চাদের জামা কেনা হল। এমনকি নিজের লেখা উপন্যাস 'মানবী'র নারী চরিত্র 'নিনিতা'র নামে কনিষ্ঠ কন্যার নামও ঠিক করে ফেলা হল। কিছুদিন পর ডাক্তারি পরীক্ষায় যখন জানা গেল মেয়ে বাচ্চাদের জামা কোনও কাজেই আসবে না, তখন মুখ শুকনা করে ঘুরতে লাগলেন হুমায়ূন আহমেদ। আমি যতবারই তাঁকে ছেলে বাচ্চাদের সুন্দর নাম খুঁজে বের করতে বলি সে ততই শুকনা মুখে বসে থাকে।
একদিন বন্ধুদের আড্ডায় অনাগত কনিষ্ঠ পুত্রের নামকরণ নিয়ে কথা ওঠায় আমি বললাম,
"একদম আনকমন একটা নাম চাই। নদীর নামে নাম হলে খুব ভালো হয়।"
হুমায়ূন বললেন, "তাহলে পুত্রের নাম রাখো 'আড়িয়াল খাঁ'। নদীর নামে নাম এবং সবচেয়ে আনকমন। এই নামের আর কোনও মানুষ পাওয়া যাবার কথা না।"
এরপর থেকে পুত্রের জন্মের আগ পর্যন্ত 'আড়িয়াল খাঁ' নামেই তাকে ডাকতেন হুমায়ূন।
আমাদের 'আড়িয়াল খা'র জন্ম রোজার মাসে। আমি তখন স্কয়ার হাসপাতালে। হাসপাতাল বিদ্বেষী হুমায়ূন আর পুত্র নিষাদ রোজ ইফতার সাথে নিয়ে চলে আসতেন সেখানে। কিছুক্ষণ শুকনা মুখে বসে থেকে বলতেন,
"কুসুম যাই। কাল আবার এই সময়ে আসব।"
২০১০ এর সেপ্টেম্বর ৬ এ 'আড়িয়াল খাঁ'র জন্ম। সেই সময় অপারেশন থিয়েটারে উপস্থিত ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। আমার নিজের আরেকটা অংশ, আমাদের কনিষ্ঠ সন্তানের জন্ম হল সেদিন। আর আমি অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলাম পৃথিবীর সুন্দরতম দৃশ্যটির দিকে। আমার হাত ধরে দাড়িয়ে আছেন হুমায়ূন, তাঁর চোখে আনন্দ আর বিস্ময়ভরা অপেক্ষা। পুত্রের কান্নার শব্দও যেন আমাকে স্পর্শ করল না। আমি চেয়ে রইলাম একজন গর্বিত বাবার দিকে যার চোখ দিয়ে কেবলই পানি ঝরছে। আর মুখে দিগ্বিজয়ীর হাসি।
কয়েকদিনের জন্য হাসপাতাল বিদ্বেষ চলেই গেল তাঁর। রোজ ঘুম ভাঙতেই চলে যান পুত্রের কাছে। আর ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করেন তাঁর 'আড়িয়াল খাঁ'র সাথে। এরই মধ্যে 'নিনিতা' থেকে আ-কার বাদ হয়ে পুত্রের 'নিনিত' নাম স্থায়ী হয়ে গেল। চারদিন বয়সী নিনিতের প্রথম ঈদ কাটল বাবার আদর খেয়ে খেয়ে। তেতাল্লিশ দিন বয়সে নিনিত মা আর ভাইকে নিয়ে রওনা হল সিলেটের হাওড় অঞ্চলে। কারণ তার বাবা সেখানে 'ঘেঁটু পুত্র কমলা' ছবির শ্যুটিং করবেন। পুত্রকে পাশে নিয়ে না শুলে তাঁর যে ঘুমই হবে না। সারাদিনের শ্যুটিং শেষে পুত্রদ্বয়ের সাথে কাটানো মুহূর্তগুলোই নাকি তাঁকে পরবর্তী দিনের কাজের শক্তি দেয়।
২০১১ এর বই মেলায় 'বাদশাহ নামদার' বইয়ের উৎসর্গপত্রে হুমায়ূন লিখলেন'
"নিনিত হুমায়ূন
আমার কেবলই মনে হচ্ছে পুত্র নিনিত পিতার কোনো স্মৃতি না নিয়েই বড় হবে। সে যেন আমাকে মনে রাখে এইজন্যে নানা কর্মকাণ্ড করছি। আমি ছবি তুলতে পছন্দ করি না। এখন সুযোগ পেলেই নিনিতকে কোলে নিয়ে ছবি তুলি।
এই বইয়ের উৎসর্গপত্রও স্মৃতি মনে রাখা প্রকল্পের অংশ।"
স্মৃতি মনে রাখা প্রকল্পের অংশ হিসেবে আরও অনেক কিছুই করেছেন হুমায়ূন আহমেদ। নিনিতের জন্মের অল্প কয়েকদিন আগে হঠাৎ তাঁর মনে হলো কনিষ্ঠ পুত্রের জন্য নিজ হাতে একটি কাঁথা বানাবেন তিনি! কাঁথা বানানোর জন্য কাপড় কেনা হলো। রং পেন্সিল দিয়ে নানান আঁকিবুঁকি করলেন সেই কাপড়ে। তারপর মধ্যখানে বড় করে লিখলেন 'গু বিলাস'! হাসতে হাসতে বললেন,
"এই কর্মকাণ্ডই তো করা হবে এইখানে।"
সেই কাপড় আমার হাতে দিলেন তাঁর আঁকিবুঁকি আর লেখা সুঁই সুতো দিয়ে ফুটিয়ে তোলার জন্যে। মনযোগের সাথে কয়েকদিন সেলাই দেখার পর একদিন হাত থেকে সুঁই সুতো নিয়ে নিজেই দিলেন কয়েক ফোঁড়।
একটি বইও লিখেছিলেন পুত্রকে নিয়ে। "রাজার কুমার নিনিত"।
"আমার নাম নিনিত।
বয়স কত জানেন? এক বছর নয় মাস। আমি শুধু অ্যাঁ, উঁ শব্দ করি।
মা আমাকে কথা শেখানোর চেষ্টা রোজ করছে। বলছে বাবা বলো তো মা। মা। মা।
আমি বলি, অ্যাঁ। অ্যাঁ। অ্যাঁ।
মা বলে, আচ্ছা ঠিক আছে বলো বাবা।
আমি বলি, অ্যাঁ।
বলো, 'বা বা'।
আমি বলি, অ্যাঁ অ্যাঁ।
আমার কাণ্ড দেখে মা খুব মন খারাপ করে, কিন্তু বাবা খুশি হয়। বাবা আমাকে ডাকে 'অ্যাঁ বাবা'।"
আরও একটি অদ্ভুত নামে ডাকতেন হুমায়ূন তাঁর কনিষ্ঠ পুত্রকে।
"ঘ্যাংগা বাবা"।
আজগুবি সব ছড়া বানাতেন পুত্রকে নিয়ে।
"আমার বাবা ঘ্যাংগা-
করলো একটু ভ্যাংগা।
অ্যাংগা ব্যাংগা চ্যাংগা..."
এই ঘ্যাংগা বাবা নিনিতের জন্মের আগের রাতে হাসপাতালের কেবিনে বসে হুমায়ূন কিছুক্ষণ লিখলেন। তারপর বাসায় ফেরার সময় আমার হাতে সেই কাগজ তুলে দিলেন।
"কুসুম, নিষাদের জন্মের আগের রাতে চিঠি লিখে তোমার হাতে দিয়েছি এটা ভুলে গেছি। তুমি মনে করিয়ে দেয়ায় ভালো হয়েছে। চিঠি লিখতে পারছি। তুমি যতটা টেনশানের ভেতর দিয়ে যাচ্ছ আমিও ঠিক ততটাই টেনশান বোধ করছি। এই টেনশান হল expectation এর টেনশান। উদাহরন দেই- পয়তাল্লিশ বৎসর আগে S. S. C পরীক্ষা দেই। আমি জানি পরীক্ষা খুব ভাল হয়েছে। এরচে' ভালো হওয়া সম্ভব না। রেজাল্ট সন্ধ্যা নাগাদ বের হবে। রেজাল্টের টেনশান।
স্মৃতি সংক্রান্ত সমস্যায় কেন আক্রান্ত হচ্ছি? আচ্ছা এই বিষয়ক একটি কবিতা-
"I wept for memory,
she sang for hope
that is so fair.
my tears were swallowed by the sea
her song climbed on the air"
[এই কবিতাটি লিখেছেন ...]
আমার জন্ম হয়েছিল মোহনগঞ্জে। প্রথম পুত্রকে দেখতে যাবার জন্যে দু'দিনের ছুটি চেয়ে বাবা দরখাস্ত করলেন। দরখাস্ত নামঞ্জুর হল। সামান্য দারোগার ছেলের জন্ম এমন কোনো বড় ব্যাপার না।
বাবা তাঁর প্রথম ছেলেকে দেখলেন তিন মাস পর। দু'দিনের ছুটিতে এসেছিলেন। তিনি কিছুক্ষণ ছেলের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় ঘোষণা করলেন, আমি এই ছেলেকে না দেখে থাকতে পারব না। আমি এদেরকে নিয়ে যাব।
অসুস্থ্ মা এবং তার তিন মাসের ছেলেকে নিয়ে সবার আপত্তি অগ্রাহ্য করে বাবা সিলেট রওনা হলেন।
প্রকৃতি চাচ্ছিল না পিতা-পুত্র বেশিদিন একসঙ্গে থাকে। মা পাগল হয়ে গেলেন। আমি একা থাকতে লাগলাম নানার বাড়িতে।
প্রকৃতি আমার বাবা এবং আমাকে নিয়ে নানান খেলা খেলেছে। আমাকে নিয়ে খেলা এখনো বন্ধ হয়নি। তোমাকে এবং তোমার পুত্রকে আমার কাছে পাঠিয়েছে খেলার সাথী করে। আরো একজন আসছে। আমার খেলাটা এবার ভাল জমবে।
হুমায়ূন আহমেদ
৬.৯.১০"
আজ ৬ সেপ্টেম্বর... আমাদের ঘ্যাংগা বাবা, রাজার কুমার নিনিতের চার বছর হল... বাবার সাথে কাটানো একটিমাত্র জন্মদিনের স্মৃতি আমার বাবুনের মনেই থাকবে না...
আমার নিন্নি পাখি... বাবুন... শুভ জন্মদিন... অনেক ভাল থাকো বাবা...
আমি নিশ্চিত... প্রকৃতি তোমার জন্য চমৎকার কোনও খেলা পরিকল্পনা করে রেখেছে...।