কবি-লেখক-শিল্পীদের ক্ষেত্রে আগে দেখতাম, প্রতিভাবানরাই সবচাইতে বিনয়ী! যিনি যতো প্রতিভাবান তিনি ততো বিনয়ী। অমিয় চক্রবর্তীর সঙ্গে আমার দেখা হলেও তার সঙ্গে কবিতা বিষয়ে কোনো কথা আমার হয়নি। কিন্তু তার পরে লিখতে আসা প্রতিভাবান এমন বাঙালি কবি নেই, যার সঙ্গে আমার কবিতা বিষয়ে আলাপ হয়নি। তাদের দেখেছি, অন্তত নিজের সৃষ্টি বিষয়ে তারা খুবই কুণ্ঠিত থাকতেন।
এখন বিনয় জিনিসটা কারোর মধ্যেই দেখি না। চারদিকে শুধু 'আমি-আমি'! যাদের কবিতায় প্রায় কিছুই নেই, তারাই বেশি উদ্ধত।
কিছুদিন আগে একটা স্ট্যাটাসে লিখেছিলাম, প্রেমের কবিতা লেখাই সবচাইতে কঠিন। গত দশ বছরে উল্লেখ করার মতো প্রেমের কবিতা আমার চোখে পড়েনি!
সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন আমার ওপর হামলে পড়লেন! আপত্তি যারা করলেন তারা বেশির ভাগই লিখছেন গত দশ-বারো বছর ধরে। তারা ধরেই নিয়েছেন, কথাটা আমি তাদের উদ্দেশ্যে বলেছি। কিন্তু কথাটা তো আমি বলেছি তাবৎ জীবিত কবিদের উদ্দেশ্যেই। কারণ গত দশ বছরে তথাকথিত দ্বিতীয় দশকের কবিরাই তো শুধু লেখেননি! আল মাহমুদসহ সকল সময়ের কবিরাই লিখেছেন। তারা তো হাত গুটিয়ে বসে থাকেননি!
আমাদের কবিদের কাঁধে 'দশকের ভুত' এমনভাবে চেপে বসে আছে যে দশ বছর বললে তারা বোঝেন দ্বিতীয় দশক! বিশ বছর বললে 'শূন্য দশকের' কবিরা মনে করেন, আমি তাদের উদ্দেশ্যে বলছি! এতো দেখি মহা সমস্যা!
দুই একজন দশকী কবি আমাকে বোঝাতে চাইলেন, তাদের সময়ের কবিরা অনেক ভালো প্রেমের কবিতা লিখেছেন। তা তো হতেই পারে। আমার দৃষ্টি তো এড়িয়ে যেতেই পারে! কিন্তু তারা আর কারোর কথা বলতে পারলেন না! বললেনও না।
তাদের কায়কারবার দেখে আমার মনে হচ্ছে, তারা শুধু নিজেদের বন্ধুবান্ধব ছাড়া আর কারোর কবিতাই পড়েন না!
বাংলা ভাষার অনেক গুরুত্বপূর্ণ কবিতা আমার যেমন মুখস্থ আছে, তেমনি অনেকেরই আছে। কোনো কবিতা বা কবিতার লাইন ভালো লেগে গেলে তা স্থায়ীভাবে মনে গেঁথে যায়। আমি তেমন 'মনে-গেঁথে-যাওয়া' কবিতার কথাই বলতে চেয়েছি। কিন্তু কেউ তেমন কোনো লাইন বা পুরো কবিতার কথা বলতে পারলেন না। দুই একজন ইনবক্সে তাদের তরুণ কবি বন্ধুদের কবিতা পাঠিয়ে তা আমাকে পড়তে বললেন। সত্যিই বলছি, তারা যেসব কবিতা পাঠালেন তা কবিতা বাচ্য নয় মোটেই। কেউ কেউ তাদের নিজেদের কবিতাও পড়তে বললেন! কেউ আমাকে ভালোবাসা থেকেই হয়তো বলেছেন। কিন্তু কারো কারো কথায় আত্মম্ভরিতাও টের পাওয়া গেছে।
সত্যিই বলছি, কোনো বিষয়ে নিজের কবিতার কথা বলতে পারার মধ্যে আত্মবিশ্বাসটা হয়তো টের পাওয়া যায়, কিন্তু আমরা যে সংস্কৃতির মধ্যে বড় হয়েছি, সেখানে তা আত্মবিশ্বাস নয়, কিছুটা আত্মম্ভরিতাই। কোনো বিষয়ে আমি অন্তত প্রকাশ্যে বলতে পারবো না- ভাই, এটা আমিই সবচাইতে ভালো লিখেছি!
আমার মনে হয়, প্রকৃত কবি বা শিল্পীর কাছে মানুষ বিনয়টাই প্রত্যাশা করে। এখনো। আপনার অবশ্য এর উল্টোটাও মনে হতে পারে! মতভেদ থাকটাকেও আমি স্বাস্থ্যকরই মনে করি। আগেও বলেছি, মতভেদ আছে যাদের সঙ্গে, তাদের কাউকেই আমি অশ্রদ্ধা করি না।
বরং খেয়াল করে দেখেছি, কিছু ব্যতিক্রম বাদে, আমি তাদের কবিতাই বেশি পছন্দ করি, যাদের সঙ্গে আমার মতের মিলের চাইতে অমিলই বেশি।
লেখক: পরিচালক, বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি
(লেখকের ফেসবুক পেইজ থেকে সংগৃহীত)
বিডি প্রতিদিন/০৮ জুলাই ২০১৭/আরাফাত