এই শহরে এখনো সেই অর্থে শীত নামেনি। রবিবার, সাপ্তাহিক ছুটির দিনের সকাল। চমৎকার ঝকঝকে রোদ আর নদীতীরের হালকা শীতল বাতাস। একপাশে ব্যস্ততম সড়কে শা শা শব্দে বিরামহীন ছুটে চলে গাড়ি। অন্যপাশে হাডসন রিভার। নদীর ঠিক মাঝ পর্যন্ত গিয়েছে কংক্রিটের ব্রিজ। যেনো গাঁয়ের কোন খালের উপর ঝুলে থাকা সাঁকো।
নান্দনিক এক পরিবেশ। সাপ্তাহিক ছুটির দিন বলেই হয়তো কারো কোন তাড়া নেই। কেউ ঘাসের উপর শুয়ে আছে সটান। কেউবা কানে হেডফোন দিয়ে মিউজিকের তালে তালে জগিং এ ব্যস্ত। কিছু গাঙচিল হেঁটে বেড়ায় সবুজ ঘাসের বুকে। পাশেই দু'জন তরুন কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে বই পড়ায় নিমগ্ন।
মানুষ আর গাঙচিল, কি অদ্ভুত সহাবস্থান! সামনে একজোড়া শ্বেতাঙ্গ কপোত-কপোতী নিচু স্বরে কথা বলছে, হাসছে নিজেদের মাঝে। গায়ে হাত বুলিয়ে আলতো আদর দিচ্ছে পোষা কুকুরকে। যেন সেই গানটির মতো, পৃথিবীতে সুখ বলে যদি কিছু থেকে থাকে, তার নাম ভালোবাসা, তার নাম প্রেম...
রিয়াসাতের স্কুল হোমওয়ার্কের অংশ ক্রিয়েটিভ রাইটিং। লেখাটি লিখবার জন্যেই ম্যানহাঁটনের এই জায়গাটি বেছে নিয়েছে সে। আমি অদূরে হাঁটছি, একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে দেখছি চারপাশ। সে গাছের নিচের বেঞ্চিতে বসে লিখে যাচ্ছে আপন মনে। কিছু সময় পর জায়গা বদল করে পানির কাছাকাছি বসছে, আবারো লিখছে গভীর মনোযোগে। ওদের লেখাপড়ার এই ধরনটি বেশ লাগে। ভয়াবহ মুখস্থ বিদ্যা নেই। পড়া মনে রাখবার মানসিক চাপ নেই। নিজ চোখে দেখে, নিজ অনুভূতিতে লেখে।
একবার এক কফি শপে দেখেছিলাম কৃষ্ণাঙ্গ এক বালিকা কোণার দিকের চেয়ারে বসে কিছু লিখছে। একটু একটু আলাপচারিতায় জানালো, তার বাবা সেই কফিশপেই চাকুরি করছে। দিনভর সেখানে বসে সে বাবার কাজ দেখবে এবং এ সম্পর্কিত একটি লেখা পরদিনই স্কুলে জমা দিতে হবে।
এই যে ছুটির দিনে বাবার কাছাকাছি থেকে তার কাজ সম্পর্কে জানা, নিজ চোখে বাবাকে কফিশপের মেঝে পরিস্কার করতে দেখা, এটি একদিকে বাবার প্রতি তার শ্রদ্ধাবোধ বাড়িয়ে দিবে, নিশ্চিত।
বেলা পড়ে এসেছে অনেকখানি। সশব্দে ছুটে চলা স্পিডবোটের দিকে চেয়ে আছি। ব্যাকপ্যক কাঁধে রিয়াসাত কাছে এসে দাঁড়ায়। তার লেখালেখি শেষ। বাড়ি ফিরবার পালা। তিনমাস আগেও ছেলেটিকে আমি পথ চেনাতাম।
অথচ আজ সে আমায় পথ চিনিয়ে নিয়ে আসে। কোন স্টেশন থেকে কোন ট্রেন নিতে হবে, কোথায় ট্রেন বদল করতে হবে, সব তার জানা। সে হাঁটে ক্রিস্টোফার এভিনিউ ধরে। আমি কেবল অবুঝ শিশুর মতো তাকে অনুসরণ করি। যেন হাঁটছি গন্তব্যহীন এক গন্তব্যের দিকে।
শীতল বাতাসের আদুরে ছোঁয়ায় টুপ করে ঝরে পড়ে ক'টি পাতা পথের উপর। সেইসব ঝরাপাতা মাড়িয়ে হাঁটছি। হেডফোনে গান শুনছি,
ঝরা পাতা উড়ে যায়, আহারে কি মায়ায়
একা একা ফিরে দেখা দক্ষিণ হাওয়ায়
কিছু কি ছিল না বলার, কিছু ধরে রাখবার
অন্ধ বাঁধনে সে পথ চলার... ...
শুভকামনা সকলকে।
(লেখকের ফেসবুক পেজ থেকে সংগৃহীত)
বিডি প্রতিদিন/২৫ অক্টোবর, ২০১৭/ফারজানা