অন্যদিনের তুলনায় নিউইয়র্কের আবহাওয়া আজ বেশ ঠাণ্ডা। সাথে ঝিরঝিরে বাতাস। বাইরে হ্যালোইনের উৎসব। শিশুরা হরেকরকম ভয়ের চরিত্রের পোশাক পরে স্কুলে গিয়েছে, প্যারেডে অংশগ্রহণ করেছে।
স্কুল শেষে দলে দলে এক দোকান থেকে অন্য দোকানের দিকে ছুটেছে। দোকানগুলো আজ শিশুদের ফ্রি ক্যান্ডি দিচ্ছে। হ্যালোইনের দিন ক্যান্ডি সংগ্রহ করার মাঝে শিশুদের আনন্দ। হোক না বাইরে হাড় কাঁপানো শীত, তাতে কি! ছোট্ট রিহান অন্যসব শিশুদের মতোই হ্যালোইন উচ্ছ্বাসে মেতে ছিল আজ। রিয়াসাত বড় হয়েছে। মসজিদে গিয়ে ধর্মীয় শিক্ষা নিয়েছে অনেকগুলো বছর। তার ধারনা, এ উৎসব মুসলমানদের জন্যে নয়। মূলত হ্যালোইন এখানকার সাংস্কৃতিক উৎসব।
এমন একটি উৎসবমুখর দিনে আচমকা এক মনখারাপ করা ইমেইল আসে। পাঠিয়েছেন Stuyvesant হাই স্কুলের প্যারেন্ট কোঅরডিনেটর। লিখেছেন, স্কুল বিল্ডিং এর বাইরে পুলিশি কার্যক্রমের কারণে ছাত্রদের স্কুলের ভিতরেই নিরাপদে রাখা হয়েছে।
আঁতকে উঠি। মায়ের মন বলেই কিনা জানি না, সবসময় এক অশুভ আতংক ভর করে থাকে বুকের ভেতরে। টিভি অন করি বিস্তারিত জানার জন্যে। ব্রেকিং নিউজ চলছে। সন্ত্রাসী হামলা! কমপক্ষে আটজনের মৃত্যু, ১২ জন আহত। আমার ছেলেটির স্কুল যে সেই এলাকাতেই! বন্ধু, স্বজনদের ফোন আসছে অনবরত। সবার একই প্রশ্ন, রিয়াসাত স্কুল থেকে ফিরেছে?
হাত, পা কেমন অবশ হয়ে আসে। যদিও ইমেইলে আশ্বস্ত করা হচ্ছিলো, ছাত্ররা যারা স্কুলের ভিতরে ছিল, তারা সকলে নিরাপদে আছে। কিছু অভিভাবক ইমেইলের উত্তর দিচ্ছিলো। সেখানে একজন লিখেছেন, আমার কন্যা এবং তার সহপাঠীরা গুলির বিকট শব্দে আতঙ্কিত হয়ে ছুটোছুটি করেছে, এবং একটি দোকানের ভেতরে আশ্রয় নিয়েছে।
প্রচণ্ড টেনশনে, ভয়ে, আতঙ্কে সম্ভবত মানুষ বোধশক্তি হারিয়ে ফেলে। আমি ছেলেকে ফোন করা, কিংবা টেক্সট করে খোঁজ নেয়ার কথা বেমালুম ভুলে গেলাম। ততক্ষণে ফোন বেজে উঠলো। রিয়াসাত জানালো সে নিরাপদে আছে। যেন দীর্ঘক্ষণ পর বুকের ভেতরে আটকে থাকা শ্বাস ফিরে এলো! সন্ধ্যার কিছু পর স্ক্রিনে ভেসে উঠলো প্যারেন্ট কোঅরডিনেটরের ইমেইল, 'স্কুল গেইট খুলে দেয়া হয়েছে, ছাত্ররা বাড়ি ফিরে যেতে শুরু করেছে।'
ট্রেন স্টেশনের সামনে গাড়ি পার্ক করে বসে আছি। ফোনে 'লাইফ ৩৬০' অন করা। একদৃষ্টে চেয়ে আছি ছেলের লোকেশনের দিকে। সে সাত নাম্বার ট্রেনে। একটু একটু করে এগিয়ে আসছে স্টেশনের দিকে। প্রযুক্তির এইদিকটা বেশ ভালো লাগে। পরিবারের কে কখন কোথায় আছে মুহূর্তেই দেখে নেয়া যায়। রোজ ঘরে বসেই দেখে নেয়া যায় ছেলে সঠিক সময়ে স্কুলে পৌঁছাতে পারলো কি না, কিংবা স্কুল শেষে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো কি না।
অবশেষে রিয়াসাত ফিরলো রাত আটটায়। নিরাপদে ফিরে এলো নিজগৃহে, মায়ের বুকে। আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলাম। যেন কতকাল কেউ আমাদের শ্বাস আটকে রেখেছিলো। যেন কতকাল বুক ভরে শ্বাস নেইনি!
প্রার্থনা জগতের সকল সন্তানের জন্যে।
শুভকামনা সকলকে।
(লেখকের ফেসবুক পেজ থেকে সংগৃহীত)
বিডি প্রতিদিন/১ নভেম্বর, ২০১৭/ফারজানা