হৃদরোগ এমন একটি জটিল রোগ যার পরিণতি অনেক ক্ষেত্রে খুবই ভয়াবহ। যার পরিপ্রেক্ষিতে বুদ্ধিমান মানুষ হৃদরোগ প্রতিরোধ করতে পূর্ব সতর্কতা অবলম্বন করে থাকে এবং কেউ হৃদরোগে আক্রান্ত হলে সঠিক চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমে সুস্থতা লাভের চেষ্টা করে থাকে। এখানে বুদ্ধিমান বলতে তাদেরই বুঝানো হয়, যারা তার পারিপাশ্বিকতা অনুধাবন করে প্রাপ্ত তথ্য বিবেচনা করে তার নিজের স্বার্থের কথা মাথায় রেখে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন। রোজা ইসলাম ধর্মের অগি্নপরীক্ষাসম একটি ইবাদতের মাধ্যমে প্রতিটি মুসলমান প্রতি বছরে একবার তার শারীরিক যোগ্যতার পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে থাকেন, তবে তা অবশ্যই একজন সুস্থ সবল মুসলমানের জন্য। মানুষ সারা বছর রকমারি খাবার খেয়ে খেয়ে মেদভুঁড়িসম্পন্ন হতে পারে এবং রোজার মাসে মেদভুঁড়ি ছাঁটাই করে আবার তার শারীরিক যোগ্যতা পুনরুদ্ধার করতে পারে।
আমি একজন সাধারণত মুসলমান হিসেবে যতটুকু জানি তা হচ্ছে ছোট শিশু, জইব ও রোগাক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য রোজা ফরজ নয়, যদি রোজার কারণে তার অসুস্থতার তীব্রতা বৃদ্ধি পাওয়ার ঝুঁকি থাকে। কি হলে রোগের তীব্রতা বৃদ্ধি পাবে তার বিবেচনার দায়িত্ব যুগে যুগে হাকিম, কবিরাজ থেকে শুরু করে বর্তমান যুগের চিকিৎসকদের ওপর বর্তায়। তাই চিকিৎসকরা সর্বোপরি রোজা রাখা বা না রাখার পরিণতি বিবেচনা করে, তার সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে পরামর্শ দিতে পারেন। এ তো গেল ব্যক্তিগত পর্যায়ে নির্দিষ্ট রোগীর জন্য আর যদি সমষ্টিগতভাবে বলতে হয় তবে যারা রোগাক্রান্ত, চলাফেরা করতে অসমর্থ, যারা দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগছেন তাদের রোজা না রাখাই শ্রেয়। মানবদেহ এমন একটি কাঠামো যাকে আল্লাহতায়ালা এমন এক ধরনের পটেনশিয়াটি বা যোগ্যতা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন, যার দরুন মানুষ অনেক কিছুই করতে পারে কিন্তু জীবনের একটা সময় পরে, মানে ৫০ বছর বয়সের পরে মানুষের শারীরিক যোগ্যতা ধীরে ধীরে কমতে থাকে, তাই বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তি যারা অত্যধিক দুর্বল, তাদের রোজা রাখা সঠিক হবে না, কারণ তারা দীর্ঘ সময় অনাহারে থাকলে খুব তাড়াতাড়ি আরও বেশি অসুস্থ হয়ে যেতে পারেন। হৃদরোগীদের হৃদরোগ চিকিৎসার হাতিয়ার হিসেবে আমরা চিকিৎসকরা অনেক ধরনের মেডিসিন ব্যবহার করে থাকি। রোজা রাখার ফলে যদি আমরা বিবেচনা করি যে এসব মেডিসিন গ্রহণের যে বিচ্যুতি হবে, তাতে রোগীর অসুস্থতা বৃদ্ধি পাবে।
হৃদরোগীদের বেলায় আরও কিছু বাড়তি সতর্কতা হিসেবে রোগীর রক্তের সুগার কন্ট্রোল, কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ অতীব জরুরি। রোজা রাখার ক্ষেত্রে এ দুটি বিষয় আমরা প্রধান্য দিয়ে থাকি। যেসব হৃদরোগী এমন ধরনের ঝুঁকিতে আছেন যে, রোজা রাখার ফলে রক্তে সুগার-কোলেস্টেরল অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যেতে পারে, তাদের জন্য রোজা না রাখাই উচিত। যারা হার্ট ফেইলুরজনিত হৃদরোগে ভুগছেন মানে হৃদরোগে জটিলতা হিসেবে পা ফোলে যায় বা হৃদরোগজনিত শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হয়ে থাকেন, তাদের বেলায় রোজা রাখার ফলে খাদ্য ও মেডিসিন গ্রহণে (অনিয়ন্ত্রিত রক্তচাপ ও হার্টের রক্ত প্রবাহের সমস্যা সৃষ্টি ইত্যাদি বিষয় অবশ্যই বিবেচনায় রাখতে হবে) বিচ্যুতির ফলে তাদের অসুস্থতা বৃদ্ধির সমূহ সম্ভাবনা থাকে, তাই হার্ট ফেইলুরের রোগীদের জন্য রোজা না রাখাই উত্তম। রোজা এক ধরনের পেরেশানি তৈরি করে। ফলশ্রুতিতে রোজাদার ব্যক্তি নিজের যোগ্যতার প্রমাণ করতে একটা মওকা পায়। প্রাপ্ত বয়স্ক সুস্থ ব্যক্তিরা রোজা রাখার ফলে তার সুস্থতা বজায় রাখা এবং উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের বেলায় তার শারীরিক যোগ্যতা বৃদ্ধির পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে পারবে। বছরে এক মাস এ ধরনের শারীরিক যোগ্যতার মহড়া রোজাদার ব্যক্তি শারীরিক যোগ্যতা বৃদ্ধি করাসহ স্বাস্থ্য রক্ষায় মুখ্য ভূমিকা রাখে। কারণ ইসলাম সর্বদাই আধুনিক একটি ধর্ম এবং তার প্রতিটি বিধানেই মানবকল্যাণে নির্মিত। রোজা আল্লাহতায়ালার নির্দেশ, এটাকে সঠিকভাবে পালন করে এর থেকে শারীরিক সুস্থতার উপাদানগুলো কাজে লাগিয়ে সুস্থ-সুন্দর ব্যাধিমুক্ত জীবন লাভ করতে পারি।
ডা. এম. শমশের আলী, সিনিয়র কনসালট্যান্ট (কার্ডিওলজি), ঢাকা মেডিকেল কলেজ, মুন ডায়াগনস্টিক সেন্টার, বাবর রোড, ঢাকা।