ভারতের অযোধ্যায় অবস্থিত বাবরি মসজিদ ধ্বংসের জন্য ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পি.ভি. নরসিমা রাও এবং রাজীব গান্ধীকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। নিজের আত্মজীবনী নিয়ে লেখা দ্বিতীয় খন্ড ‘দ্য টার্বুলেন্ট ইয়ারস ১৯৮০-১৯৯৬’ বইটিতে এমনই অভিযোগ করেছেন তিনি।
বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ফলে ভারতের বহুত্ববাদী ভাবমূর্তিতেও একটা কালির দাগ পড়েছিল বলে বর্ণনা করে তিনি বলেন, ‘বাবরি মসজিদের ধ্বংস ঠেকাতে না পারাটা ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পি.ভি.নরসিমা রাও’এর বড় ব্যর্থতা। অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ ও কঠিন বিষয়ে আলোচনার জন্য নারায়ণ দত্ত তিওয়ারি(এন.ডি.তিওয়ারি)-এর মতো উত্তরপ্রদেশের রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কোন সিনিয়র ও অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদের ওপর ভার দেওয়া উচিত ছিল বলেও জানিয়েছেন তিনি।
একইসঙ্গে প্রার্থনাকারীদের জন্য একটি জায়গাকে খুলে দেওয়া নিয়ে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর ভূমিকারও প্রশ্ন তুলেছেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। ‘১৯৮৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারী রাম জন্মভূমি মন্দির খুলে দেওয়াটাও সম্ভবত অন্য আরেকটা ভুল ছিল এবং সাধারণ মানুষ ভেবেছিলেন যে এই পদক্ষেপটা এড়ানো যেত’।
শুক্রবারই রাষ্ট্রপতি ভবনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তাঁর আত্মজীবনীর দ্বিতীয় খন্ডটি প্রকাশ করেন উপ-রাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারি। ১৯৮০ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত তাঁর রাজনৈতিক জীবনের ছোট ছোট অনেক অজানা ঘটনাই তুলে ধরা হয়েছে বইটিতে। এর আগে ১৯৬৮ থেকে ১৯৭৯ পর্যন্ত সময়সীমার বিবরণী সম্পর্কিত নানা কাহিনী নিয়ে আত্মজীবনীর প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়েছিল।
আত্মজীবনীতে রাষ্ট্রপতি আরও জানিয়েছেন বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরই পরিস্থিতি এক নাটকীয় মাত্রা নেয়। ক্যাবিনেট মিটিং চলাকালীই কংগ্রেসের সংসদ সদস্য সীতারাম কেশরি কেঁদে ভাসিয়ে দেন। ওই বৈঠকে আমিও সেদিন উপস্থিত ছিলাম। আমি তাঁকে বলেছিলাম এখানে অত নাটকিয়তা করার কোন কারণ নেই। আপনাদের সবাই ক্যাবিনেটের সদস্য এবং কয়েকজন সংসদীয় বিষয়ক ক্যাবিনেট কমিটির সদস্য। এই বৈঠকেই সব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। তাই আমাদের সবাইকেই এই দায় নিতে হবে। এর দায় কেবলমাত্র প্রধানমন্ত্রী কিংবা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ওপর বর্তায় না’।
প্রণব মুখোপাধ্যায় লিখেছেন ‘এরপর একদিন পি.ভি(পি.ভি.নরসিমা রাও)-এর সঙ্গে একান্ত বৈঠকে বসেছিলাম। আমি সেদিন কোন রাখ-ঢাক করিনি। একটু উত্তেজিত হয়েই তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম এই ভয়ঙ্কর বিপদের সময় আপনাকে পরামর্শ দেওয়ার কি কেউ ছিল না? বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরে বিশ্ব জুড়ে কি ধরনের প্রতিক্রিয়া হতে পারে সে বিষয়ে আপনার কি কোন ধারণা ছিল না? যাই হোক সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা প্রশমিত করার পাশাপাশি মুসলিমদের ভাবাবেগকে শান্ত করতে এখনই আপনার কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত’।
রাষ্ট্রপতি জানান, ‘আমি যখন কথাগুলো বলছিলাম পি.ভি তখন আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল এবং তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট অনুযায়ী তাঁর মুখে কোন আবেগ/প্রতিক্রিয়া দেখিনি। কিন্তু তা সত্তেও আমি তার সঙ্গে কয়েক দশক কাটিয়েছি’।
বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনাকে ‘চূড়ান্ত বিশ্বাসভঙ্গ’-এর সঙ্গে তুলনা করে রাষ্ট্রপতি তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন ‘এই ঘটনার জন্য প্রতিটি ভারতবাসীরই লজ্জায় তাদের মাথা নিচু করা উচিত। এরকম একটি ধর্মীয় কাঠামোকে ধ্বংসের ঘটনা একটা শুভবুদ্ধিহীন ও উচ্ছৃঙ্খলতার কাজ, রাজনৈতিক উদ্যেশ্যর জন্যই এই ধরনের কাজ করা হয়েছিল। এর ফলে ভারত এবং পুরো বিশ্বের মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের ভাবাবেগে বড় আঘাত সৃষ্টি করেছিল। সহিষ্ণুতা, বন্ধুত্ববাদীর দেশ হিসাবে ভারতের যে ভূমিকা ছিল, এই ঘটনা সেই ভাবমূর্তিকেও কে ক্ষতি করেছিল।
প্রসঙ্গত, আধুনিক ভারতের ইতিহাসে ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর দুর্বৃত্তরা ধ্বংস করে দিয়েছিল উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যার বিখ্যাত বাবরি মসজিদকে।
বিডি-প্রতিদিন/২৯ জানুয়ারি, ২০১৬/মাহবুব