সম্প্রতি নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন পাস করেছে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত। দেশটির জাতীয় সংসদ তথা রাজ্যসভা ও লোকসভায় সংসদ সদস্যদের প্রত্যক্ষ ভোটে সংগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে আইনটি পাস হয়।
এরই মধ্যে এই আইনটি অনেক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। এ নিয়ে শোনা যাচ্ছে অনেক আলোচনা-সমালোচনাও। এমনকি আইনটি নিয়ে দেশটির বেশ কয়েকটি রাজ্যে সহিংস আন্দোলনের কথাও এসেছে গণমাধ্যমে।
এছাড়াও শোনা যাচ্ছে, এই আইনটি পাসের কারণে বাংলাদেশসহ ভারতের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো উদ্বিগ্ন।
আসলেই কি ভারতের এই আইন নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনও কারণ আছে? এই প্রশ্নের দ্ব্যর্থহীন জবাব ‘না’। তাছাড়া, ভারতে নাগরিকত্ব চাইছেন এমন বাংলাদেশির সংখ্যা খুবই কম।
আমাদের এই দুই দেশের মধ্যে যেটা হচ্ছে, তা হল বিভিন্ন কারণে মানুষ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে যাতায়াত করছে। আর এর অন্যতম কারণ সীমান্তে নিরাপত্তাজনিত দুর্বলতা।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার আন্তর্জাতিক সীমান্তের কাছে বসবাসকারী মানুষের সীমানা পেরিয়ে আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে। তাদের কেউ কেউ আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করতে অবৈধভাবে আন্তর্জাতিক সীমানা অতিক্রম করছে। এছাড়া, কেউ কেউ অবৈধ ব্যবসা এবং গবাদিপশু পাচারের সঙ্গে জড়িত রয়েছে।
তবে, যখন স্থায়ী নাগরিকত্ব চাওয়ার বিষয়টি সামনে আসে, তখন কতজন বাংলাদেশি সত্যিকার অর্থে ভারতীয় নাগরিক হতে চায় তার কোনও পরিসংখ্যান আজ পাওয়া যায় না। অথচ ভারতে গড়পড়তাভাবে বসবাসকারী বাংলাদেশির সংখ্যা একটি বড় ফ্যাক্টর। যুগান্তকারী অর্থনৈতিক অগ্রগতির কারণে বর্তমানে বাংলাদেশ ভারতের চেয়েও বেশি কর্মসংস্থানের সুযোগ দিচ্ছে। বহুসংখ্যক সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মানুষ বিশেষত হিন্দুরা ভারতে স্থায়ী হতেও আগ্রহী নয়। তারপরও ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের বিষয়ে বাংলাদেশের হৈচৈ অপ্রয়োজনীয়। বরং এটা বাংলাদেশের জন্য উৎপাদনশীল (কাউন্টার-প্রোডাক্টিভ) হবে।
যদিও ভারতের প্রায় সব বিরোধী রাজনৈতিক দল এই বিলটি পাসের বিরোধিতা করছে। কিন্তু একটি মজার বিষয় হল, কংগ্রেস নেতৃত্বধানী বিরোধী রাজনৈতিক জোট এই সংক্রান্ত আইন বিগত কয়েক বছর আগে পাস করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তারা অভ্যন্তরীণ বাধার কারণে তা করতে পারেনি।
প্রতিবেশি রাষ্ট্রগুলোর চেয়ে এই বিলটি নিয়ে ভারতের অভ্যন্তরীণ সমস্যাই বেশি। এমতাবস্থায়, বাংলাদেশ অহেতুক এই আইনের সমালোচকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে।
এটাও বলা হয় যে, বিলটি পশ্চিমবঙ্গ কেন্দ্রিক বেশি, কারণ ক্ষমতাসীন বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে চির রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিতাড়িত করার লক্ষ্য নিয়েছে।
ত্রিপুরায় নতুন সরকার গঠনের পর, ত্রিপুরা রাজ্য সরকার ও বাংলাদেশের মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিরাট অগ্রগতি হয়েছে। নতুন নাগরিকত্ব আইনটি ক্ষমতাসীন বিজেপির অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্বার্থ বিবেচনায় করা হয়েছে।
নাগরিকত্বের অধিকার বিশ্বজুড়েই একটি বিতর্কিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। পশ্চিমা ইউরোপীয় দেশগুলো যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান, সিরিয়া ও ইরাক থেকে শরণার্থীদের ঢল ঠেকাতে সীমান্ত ব্যবস্থাপনা কঠোর করেছে।
এসব শরণার্থী নিজ দেশের সংঘাত থেকে বাঁচতে যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ইতালি এবং ফ্রান্সের মতো দেশে যেতে অসাধু মানব পাচারকারীদের মোটা অঙ্কের অর্থ প্রদান করছে। সমুদ্র পথে এসব দেশে পাড়ি জমাতে গিয়ে হাজার হাজার মানুষ সমুদ্রেই মারা যাচ্ছে, নয়তো সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গুলির মুখে পড়ছে। এ সংক্রান্ত বেশির ভাগ গল্পই আমাদের অজানা।
এমনকি তুরস্কও সিরিয়া থেকে শরণার্থী প্রবাহ ঠেকাতে বিধিনিষেধ জারি করেছে। যদিও এই মানুষগুলো একই ধর্ম ও জাতিগোষ্ঠীর। তথাপি তারা অভ্যন্তরীণ আশঙ্কায় সিরিয়ার এসব শরণার্থীদের গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
এক্ষেত্রে বাংলাদেশই ব্যত্ক্রিম। যারা বিশ্বের একমাত্র দেশ হিসেবে অতি সহানুভূতিশীতার পরিচয় দিয়ে শরণার্থী ঢলকে স্বাগত জানিয়েছে। যারা বিভিন্ন রকমের অভ্যন্তরীণ সমস্যা সত্ত্বেও মিয়ানমারের ১২ লাখেরও বেশি শরণার্থী গ্রহণ করেছে।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, তেল সমৃদ্ধ উপসাগরীয় দেশগুলোও মুষ্টিমেয় রোহিঙ্গা, যারা বাংলাদেশ থেকে সেসব দেশে গিয়েছিল, তাদেরকে থাকার অনুমতি দেয়নি।
মুষ্টিমেয় এসব রোহিঙ্গা, যারা সৌদি আরবের মতো দেশে ধনী দেশে গিয়েছিল, তাদেরকে সেখানে থাকতে দেওয়া হয়নি। তাদেরকে জোরপূর্বক বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
ভারত শরণার্থী সংক্রান্ত কনভেনশন ১৯৫১ ও ১৯৬৭ এর স্বাক্ষরকারী দেশ নয়। এছাড়াও, এ সংক্রান্ত তাদের জাতীয় তথা নিজস্ব নীতিমালাও নেই। বিশ্বের সব শরণার্থীকেই ‘অবৈধ’ হিসেবে শ্রেণিভুক্ত করা হয়। ভারত শরণার্থীদের গ্রহণে ইচ্ছুক। তবে এক্ষেত্রে ভারতের অবস্থান হচ্ছে- নিজ দেশে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তাদেরকে অবশ্যই ফিরে যেতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসী ও শরণার্থী কমিটির তথ্যানুসারে, ইউএনএইচসিআর’র মাধ্যমে ভারত সাড়ে ৪ লাখের বেশি শরণার্থী গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে ২ লাখ শরণার্থী এসেছে অপ্রতিবেশি রাষ্ট্র থেকে।
২০১৫ সালে ভারত সরকার এ জাতীয় শরণার্থীদের দীর্ঘমেয়াদী ভিসা দিয়ে বৈধ করেছে। তারা ঘোষণা দিয়েছিল, ‘বাংলাদেশি এবং পাকিস্তানি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নাগরিকদের পাসপোর্ট (ভারতে প্রবেশ) আইন ১৯২০ এবং পররাষ্ট্র আইন, ১৯৪৬ থেকে থেকে অব্যাহতি দেওয়া হবে।
এক্ষেত্রে বিশেষত, ‘হিন্দু, শিখ, খ্রিস্টান, জৈন, পারসি এবং বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কথা উল্লেখ করা হয়, যারা ধর্মীয় নিপীড়ন ও নির্যাতনের ভয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল। তবে এই সুবিধা তারাই পাবেন যারা ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের আগে ভারতে পাড়ি জমিয়েছে।
ভারত সরকারের মতে, বিদ্যমান নাগরিকত্ব আইনের ৫ ও ৬ ধারায় ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা ছাড়াই যে কোনও শ্রেণির অভিবাসীর ভারতীয় নাগরিকত্ব অর্জনের আইনি বিষয়ের অধিকার দেওয়া আছে। এই বিধানের আওতায় কয়েকশ’ মুসলমানকে গত কয়েক বছরে ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়েছে।
ভারতের নাগকিত্ব সংশোধনী বিল ও বাংলাদেশ
ভারতের নাগকিত্ব সংশোধনী বিল নিয়ে বাংলাদেশ সুবিবেচনাহীনভাবে সমালোচকের ভূমিকায় অবতরণ করেছে, যা সত্যিকার অর্থেই ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়।
আগমাী ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশের শ্রেণিভুক্ত হওয়ার পথে। এই প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ এর আর্থ-সামাজিক সূচকগুলো ইতিবাচকভাবেই এগিয়ে চলেছে।
বাংলাদেশ ২০২০-২১ মেয়াদে ৮ শতাংশেরও বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে, যা বিশ্বে সর্বোচ্চ। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং নাগরিকদের জীবনের মান সূচকও সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষে। শুধু তা-ই নয়, এই অঞ্চলে বাংলাদেশের একজন দক্ষ শ্রমিকের গড় বেতনও সর্বোচ্চ।
সুতরাং বাংলাদেশ তার নাগরিকদের কর্মসংস্থান চাহিদা পূরণে সক্ষম হবে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ভারতসহ প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে এর অর্থনীতি পরিচালনার জন্য জনশক্তি আমদানির প্রয়োজন হবে।
যেহেতু এই অঞ্চলে বাংলাদেশের ধর্মীয় সম্প্রীতি অন্যতম, তাই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কোনও সদস্যই ভারতে নাগরিকত্ব পেতে আগ্রহী হবেন না।
বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায় এখানকার সমাজে ভালভাবে বসবাস করছে এবং নিজের বাংলাদেশি পরিচয়ের অংশ হতে পেরে গর্বিত মনে করে তারা। আগামীতে ভারতের নাগরিকত্ব নিতে বাংলাদেশি কাউকে খুঁজেই পাওয়া যাবে না।
ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়ে যে শোরগোল চলছে তা একান্তই ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়।
বাংলাদেশের কিছু স্বাধীনতা বিরোধী দল এবং সংগঠন অহেতুকভাবে এই বিষয়টি নিয়ে মাঠ গরম করার চেষ্টা করছে। উদ্ভূত পরিস্থতিতে বর্তমানে প্রয়োজন সমাজে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখা এবং প্রতিবেশী দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি উপাদানগুলোকে কাজে লাগানোর সুযোগ না দেওয়া।
বিডি প্রতিদিন/কালাম