স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ‘করোনাকালে চিকিৎসকদের পাশাপাশি যারা ফ্রন্টলাইনার হিসেবে কাজ করেছেন তাদের মধ্যে পুলিশ ছিল অন্যতম। করোনা মোকাবিলায় কোনোকিছুর তোয়াক্কা না করে দেশ ও জনগণের কল্যাণে যা যা করা প্রয়োজন সব করেছে পুলিশ। তারা দায়িত্ব পালনে কোনো সময় অবহেলা করেননি। করোনাকালে পুলিশ এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে।’
আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর রাজারবাগে বাংলাদেশ পুলিশ অডিটোরিয়ামে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় এসব কথা বলেন তিনি। কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালনকারী পুলিশ সদস্যদের কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ করোনা ইনসিগনিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে উন্মোচন উপলক্ষে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ। স্বাগত বক্তব্য দেন অতিরিক্ত আইজি (এফঅ্যান্ডএল) এস এম রুহুল আমিন। অনুষ্ঠানে অতিরিক্ত আইজি (এঅ্যান্ডআই) ড. মো. মইনুর রহমান চৌধুরী, ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম, র্যাব মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, অতিরিক্ত আইজিবৃন্দ, ঢাকাস্থ পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের প্রধান, ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা এবং পুলিশ সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
করোনা ইনসিগনিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে উন্মোচনের পর আইজিপি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ইনসিগনিয়া পরিয়ে দেন। পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একে একে আইজিপি, অতিরিক্ত আইজিদের এবং পুলিশ সদস্যদের করোনা ইনসিগনিয়া পরিয়ে দেন।
অনুষ্ঠানের শুরুতে করোনাকালে জীবন উৎসর্গকারী পুলিশ সদস্যদের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। পরে করোনাকালে পুলিশের অনন্য সাধারণ অবদানের ওপর একটি ডকুমেন্টারি প্রদর্শন করা হয়।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পুলিশ সদস্যদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আপনারা আবারও প্রমাণ করলেন পুলিশ জনগণের পাশে থাকে, ভবিষ্যতেও পাশে থাকবে।’
‘করোনা কীভাবে আমাদের পর্যুদস্ত করেছে তা আপনারা দেখেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী নেতৃত্বে দেশে করোনা মোকাবিলায় লকডাউন, কোয়ারেন্টাইন বাস্তবায়ন, অসুস্থ রোগীকে হাসপাতালে পৌঁছানো, তাদের বাড়িতে খাবার পৌঁছে দেওয়া, করোনায় কেউ মারা গেলে যখন আত্মীয়-স্বজনরা লাশ ফেলে চলে গেছেন তখন লাশের দাফন ও সৎকার করা, এমনকি কৃষকের ধান কাটার ব্যবস্থাও করেছে পুলিশ।’
করোনা মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালের অনন্য সাধারণ অবদানের কথা উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘করোনা রোগীদের চিকিৎসায় যখন দেশের অনেক বড় বড় হাসপাতাল কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছে, সেখানে পুলিশ হাসপাতাল করোনা চিকিৎসায় অভাবনীয় সাফল্য দেখিয়েছে। তারা শুধু পুলিশ সদস্যদের নয়, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার সাধারণ মানুষকেও চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন।’
তিনি করোনাকালে জনগণের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের সেবা দেওয়ার কাজে নেতৃত্ব দেওয়ায় আইজিপি এবং পুলিশ সদস্যদের বিশেষ ধন্যবাদ জানান।
সভাপতির বক্তব্যে আইজিপি বলেন, ‘করোনাকালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ পুলিশ এক মহাকাব্যিক যুদ্ধে লিপ্ত হয়। পুলিশকে সারাবিশ্বের মত আমাদের দেশেও ফ্রন্টলাইনার হিসেবে কাজ করতে হয়েছে। করোনাকালে দেশ ও জনগণের কল্যাণে বাংলাদেশ পুলিশের ১০৭ জন গর্বিত সদস্য জীবন উৎসর্গ করেছেন। এ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন ২৬ হাজারের বেশি পুলিশ সদস্য। আক্রান্তরা সুস্থ হয়েই দেশ ও জনগণের কল্যাণে আবার নিজেদের নিয়োজিত করেছেন।’
তিনি বলেন, ‘প্রথম দিকে করোনা সংক্রমণে প্রতিদিন প্রায় ৭-৮ শ' পুলিশ সদস্য আক্রান্ত হয়েছেন। আমাদের পিপিপি নেই, হ্যান্ড গ্লাভস নেই, মাস্ক নেই। তবুও আমরা জনগণের পাশে ছিলাম। এজন্য আমাদের সদস্যদের সংক্রমণের হার বেড়ে গিয়েছিল। আমরা নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জনগণকে সেবা দিয়েছি এবং পরে নিজেদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করেছি। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশনা পেয়েছি। বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণের প্রথম দিন থেকেই বাংলাদেশ পুলিশ সম্মুখযোদ্ধা হিসেবে কাজ করেছে।’
আইজিপি বলেন, ‘করোনা মোকাবিলায় বাংলাদেশ পুলিশের কোনো পূর্ব ধারণা ছিল না। আমরা বাংলাদেশে বিভিন্ন দূতাবাসে নিযুক্ত উন্নত এবং পার্শ্ববর্তী দেশের পুলিশ লিয়াজোঁ অফিসারদের ডেকে নিয়ে এসে তাদের সাথে বসে করোনা মোকাবিলায় আমাদের দেশের উপযোগী করে বাংলাদেশ পুলিশের জন্য স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) তৈরি করেছি। পুলিশ সদস্যদের করোনা চিকিৎসার জন্য একটি বেসরকারি হাসপাতাল ভাড়া করা হয়েছে। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে কমিউনিটি সেন্টার, হোটেল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভাড়া করে পুলিশ সদস্যদের চিকিৎসা ও কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কমিউনিটি সেন্টারে তাদের থাকার জন্য বিছানা ও আসবাবপত্রের ব্যবস্থা করা হয়েছে, তাদের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালকে ২৫০ শয্যার সাধারণ হাসপাতাল থেকে মাত্র এক মাসের মধ্যে কোভিড হাসপাতালে রূপান্তর করা হয়েছে। আমরা সর্বপ্রথম পুলিশ হাসপাতালে আইভারমেট্রিন ব্যবহার করেছি। বিদেশি হাসপাতালের সঙ্গে পুলিশ হাসপাতাল করোনা চিকিৎসা নিয়ে গবেষণা করেছে। আমরা প্রথম প্লাজমা থেরাপি প্রয়োগ করেছি। করোনা চিকিৎসায় পুলিশ হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মী সবাই অতিমানবীয় কাজ করেছেন।’
তিনি বলেন, ‘যত সহজে এ কথাগুলো বলেছি তা করা খুব সহজ ছিল না।’
করোনা ইনসিগনিয়া প্রদান প্রসঙ্গ উল্লেখ করতে গিয়ে ড. বেনজীর আহমেদ বলেন, ‘র্যাব যখন সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত করেছে তখন মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তখনকার র্যাব প্রধান হিসেবে আমাকে বলেছেন আপনারা এত বড় একটা কাজ করলেন আমি আপনাদের জন্য কিছু করতে চাই। তিনি আমাদের আর্থিক অনুদান দিতে চেয়েছেন, সনদপত্র দিতে চেয়েছেন। তখন আমরা মাননীয় মন্ত্রীকে প্রস্তাব দিলাম যে, আমাদের একটি ইনসিগনিয়া প্রদান করেন, যাতে আমরা মর্যাদার সাথে এটা পরতে পারি। পরে উনি আমাদের ইনসিগনিয়া প্রদান করেছেন। এবারও করোনা মোকাবিলায় বাংলাদেশ পুলিশ সদস্যদের অনন্য সাধারণ অবদানের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আমাদের করোনা ইনসিগনিয়া প্রদান করেছে। আমি এজন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা জানাই। সরকারের দেওয়া এ ইনসিগনিয়া দেশ ও জনগণের পাশে থাকতে পুলিশ সদস্যদের আরও বেশি অনুপ্রেরণা যোগাবে।’
উল্লেখ্য, বৃত্তাকৃতির দেড় ইঞ্চি-পৌনে দুই ইঞ্চি ব্যাসের কোভিড-১৯ ইনসিগনিয়ায় ব্যবহৃত বাটসহ ছুরি দ্বারা করোনাভাইরাসকে বিদ্ধ করা হয়েছে, যা ‘অদম্য ও কার্যকরী মোকাবিলার’ প্রতীকী অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। ইনসিগনিয়ায় ব্যবহৃত মুষ্টিবদ্ধ হাত করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় সম্মুখ যোদ্ধাদের দৃঢ় প্রত্যয়ের প্রতীক।
বিডি প্রতিদিন/জুনাইদ আহমেদ