ইস্কুলের লাইব্রেরিতে খুব কম গল্পের বই-ই বাকি ছিল, যেগুলো পড়া হয়নি আমার। পাবলিক লাইব্রেরি থেকেও বই নিয়ে আসতাম। ইস্কুলে যাওয়ার রিক্সাভাড়া বাঁচিয়ে ঝালমুড়ি নয়, আইসক্রিম নয়, চুড়ি-ফিতে নয়, বই কিনতাম। গাঙ্গিনার পাড়ে ছিল দুটো নির্জন বইয়ের দোকান। টাকা জমিয়ে ওই দুটো দোকানেই ছুটে যেতাম। বইপোকা বলে খুব দুর্নাম ছিল। রাত জেগে বই পড়া তো ছিলই। পাঠ্য বই দিয়ে গল্পের বই আড়াল করে বছরের পর বছর পড়েছি। ধরা পড়ে বাবা-মা'র হাতে প্রচুর চড়-থাপ্পড়, কিল-ঘুসি খেয়েছি। কে রুখবে আমাকে! বিকেলে ছাদে চলে যেতাম বই নিয়ে। সন্ধ্যে নামতো, বই থেকে চোখ সরতো না, খুব ঘোরের মধ্যে থাকলে হয়তো বোঝা যায় না যে অন্ধকার থেকেও সময় সময় আলো ঠিকরে বেরোয়।
মাঝে মাঝে ভাবি, আমার অমন বই পড়ার অভ্যেসটা কোত্থেকে হয়েছিল। বাড়িতে তো গল্পের বই পড়ার খুব বেশি চল ছিল না। বাবা ডাক্তারি বই পড়তেন। মা কোরান-হাদিস পড়তেন। দাদারা বইয়ের চেয়ে ম্যাগাজিন-ট্যাগাজিন বেশি পড়তেন। অভ্যেসটা সম্ভবত নানির বাড়ি থেকে এসেছে। ও-বাড়িতে সাত-আট বছর বয়স অবধি ছিলাম। তখনই দেখেছি, নানির ঘরে বিকেল হলেই বই পড়ার আসর বসে। মেজ খালা বা ছোট খালা পড়েন, বড় মামা, মেজ মামা, মা, নানি, নানির পড়শিরা শোনেন। কোনও ধর্মের বই নয়। গল্প-উপন্যাস। কোনওদিন প্রেমের গল্প, কোনওদিন রহস্য উপন্যাস।
পড়ার অভ্যেসই আমাকে লেখার অভ্যেস দিয়েছে। ইস্কুলের বড় ক্লাসে উঠে রাফ খাতাগুলোকে লেখার খাতা বানিয়ে ফেলি, প্রচুর গল্প-কবিতা লিখি। ওসব খাতা ইস্কুলে নিয়ে গেলে কাড়াকাড়ি পড়ে যায়। মেয়েরা গোগ্রাসে আমার লেখা পড়ে। বাড়িতে নিয়ে যায় পড়তে, একজন ফেরত দিলে আরেকজন নেয়। মফস্বলের লিটল ম্যাগাজিনে, এমনকী ঢাকার বড় পত্রিকাতেও বেরোতে থাকে লেখা। একসময় কবিতাপত্র সম্পাদনা আর প্রকাশনা দুটোই করতে শুরু করি। সবে তখন সতেরো বছর বয়স আমার। ইস্কুল-কলেজের বাইরে কোথাও যাওয়া নিষেধ। তখনও বাড়িতে বাবা বা দাদাদের বন্ধুরা এলে পর্দার আড়ালে চলে যেতে হয়। বাইরে শৃঙ্খল, ভেতরে অদম্য কৌতূহল। তত দিনে ধর্ম থেকে, কুসংস্কার থেকে, অসংখ্য নারীবিরোধী প্রথা থেকে একা একাই নিজেকে মুক্ত করেছি। উৎসব বলতে যদি কিছুর প্রতি আমার টান থাকে, সে ঈদ নয়, পুজো নয়, বড়দিন নয়, শবে-কদর নয়, শবে-বরাত নয়, মহররম নয়, মিলাদুন্নবী নয়, সে বইমেলা।
ঢাকায় বিশাল বইমেলা হয়। কেবল শুনেছিই, দেখা হয়নি। স্বপ্ন ছিল একুশে ফেব্রুয়ারির ভোরে 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি...' গাইতে গাইতে ঢাকার রাস্তায় খালি পায়ে হাঁটার, শহিদ মিনারে ফুল দেওয়ার, বইমেলা ঘুরে ঘুরে বই কেনার। স্বপ্ন, আশ্চর্য, একদিন সত্যি হয়। আমার ছোট খালা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। আমার কান্নাকাটিতে একদিন তিনি আমাকে ঢাকায় নিয়ে গেলেন। মা-র অনুমতি নেওয়া হয়েছিল। বাবার অনুমতি চাইনি, কারণ, চাইতে গেলে তিনি পায়ের টেংরি ভেঙে আমাকে ঘরে বসিয়ে রাখবেন। লেখাপড়া বাদ দিয়ে ঢাকা শহরে 'ফুর্তি' করতে যাওয়ার অনুমতি তিনি পৃথিবী উল্টে গেলেও দেবেন না। ফিরে আসার পর বাবার হাতে সন্ধি-বেতের মার খেয়েছিলাম। সেই মার আমার পিঠের চামড়া তুলে নিয়েছিল, কিন্তু কোনও অনুশোচনা দেয়নি। সেই থেকে যা কিছুই ঘটুক, চড়-থাপ্পড়, সন্ধিবেত, চাবুক- পরোয়া করিনি। যেখানেই থাকি, যত দূরেই থাকি, ঢাকার বইমেলায় ছুটে-ছুটে গেছি। এ বইমেলা কোনওকালেই ঠিক বইমেলা ছিল না আমার কাছে, ছিল প্রাণের মেলা। একটি মাস আসবে বলে বছরের এগারো মাস অপেক্ষা করেছি। সারা বছরের বই এক মাসেই কিনেছি। বাবা গজরাতেন, 'মেডিক্যালে পড়ছো, কোথায় চোখে সর্ষের তেল ঢেলে সারারাত মেডিক্যালের বই পড়বে, তা নয়তো 'আউট বই'-এর নেশায় ঢাকায় গেছো, এই 'আউট বই'ই তোমার মেডিক্যালের পড়ার বারোটা বাজাবে, এ জন্মে তোমার আর ডাক্তারি পাস হবে না।'
বাবার ভবিষ্যদ্বাণী ঠিক ছিল না। আমি নির্বিঘ্নে ডাক্তারি পাস করেছি। ডাক্তারির ফাঁকে ফাঁকে লেখালেখি করতাম। একসময় আমার বই বেরোনো শুরু হলো। কবিতার বই, প্রবন্ধের বই, গল্প-উপন্যাস। সে-সব বই বইমেলার স্টলে স্টলে বিক্রি হতে লাগলো। লাইনে দাঁড়িয়ে মানুষ আমার বই কিনতো। পাঠকেরা ভিড় করতো আমার সঙ্গে একটুখানি কথা বলার জন্য, বইয়ে সই নেওয়ার জন্য। অনেক লেখক-কবির সঙ্গে দেখা হতো, মতবিনিময় হতো। বইমেলায় যেদিকে দু'চোখ যেতো, দেখতাম শুধু বই আর বইয়ের পাঠক। বই দেখতে, বই কিনতে, বই পড়তে মানুষ উপচে পড়ছে। অন্ধকার কবন্ধের যুগে এর চেয়ে চমৎকার দৃশ্য আর কী হতে পারে! একজন লেখকের জন্য এ যদি বেহেস্ত না হয়, বেহেস্ত তবে কোথায়?
আমার লেখা শুরু থেকেই কেবল লেখার জন্য লেখা ছিল না। নারীর ওপর ধর্ম আর পুরুষতন্ত্রের অত্যাচারের বিরুদ্ধে অনড় দাঁড়িয়ে যা লেখার লিখেছি। মুক্তচিন্তকরা আমাকে ভালোবেসেছেন। কিন্তু আমার পথরোধ করে দাঁড়িয়েছে মৌলবাদী গোষ্ঠী। বইমেলায় আমাকে আক্রমণ করেছে, আমার বই পুড়িয়েছে। রাস্তায় লক্ষ লোক আমার ফাঁসি চেয়ে মিছিল করেছে। আমার মাথার দাম ঘোষণা করেছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সরকার কোথায় বাকস্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়াবে, তা নয়, মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছি- এই অভিযোগে আমার বিরুদ্ধে মামলা ঠুকেছে, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে। আমাকে বাধ্য করেছে দেশ ছাড়তে। আমাকে নিষিদ্ধ করেছে।
ইউরোপের নির্বাসিত জীবনে অনেক বইমেলায় গিয়েছি। কিন্তু মন ভরেনি। মন পড়ে থাকতো বাংলার বইমেলায়। কুড়ি বছর আগের কথা। ভারতের ভিসা চেয়েছি কিন্তু ভিসা দেওয়া হয়নি। ছ'বছর পর যখন ভিসা দেওয়া হলো, আর দেরি করিনি, ছুটে গিয়েছি কলকাতার বইমেলায়। পৃথিবীর যেখানেই থাকি, যত দূরেই থাকি, যত ব্যস্ততাই থাকুক আমার, সব ফেলে, সব ঠেলে প্রতি বছর বইমেলায় গিয়েছি। মেলায় ঘুরে বেড়িয়েছি, নতুন বইয়ের গন্ধ শুঁকেছি, বই কিনেছি, পড়েছি, বাঙালি পাঠকের সঙ্গে আড্ডা দিয়েছি, বাঙালি কবির কবিতা পড়া শুনেছি। বাংলা বইমেলা আমাকে আমার হারিয়ে যাওয়া দেশ দিতো। যে ভাষা আমার মায়ের ভাষা, যে ভাষা আমার ভাষা, যে ভাষায় আমি বই লিখি, ভাবি, স্বপ্ন দেখি- সে ভাষার কাছে গিয়ে, সে ভাষার বইমেলায় গিয়ে আমার নির্বাসনের দুঃখ যন্ত্রণা অনেকটাই আমি ভুলে গিয়েছিলাম।
একসময় ভাষার টানে কলকাতায় বাস করতে শুরু করি। কলকাতার সঙ্গে আমার সম্পর্ক অনেককালের। ছোটবেলা থেকেই কলকাতার সাহিত্য পড়ি। আমার কবিতাপত্র 'সেঁজুতি'-তে কলকাতার অনেক কবিই লিখতেন। আমিও লিখতাম তাঁদের কাগজে। বড় ভালোবেসেছিলাম কলকাতাকে, অথচ বছর তিন পার হতেই কলকাতা ঠিক ঢাকার মতোই আচরণ করলো। আমাকে গৃহবন্দি করে রাখলো চার মাস। তারপর গোটা রাজ্য থেকেই ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিলো। আমার অপরাধ, আমাকে মৌলবাদীরা পছন্দ করে না। আমাকে পছন্দ না করার অনেকগুলো কারণ আছে, আমি নারীকে দাসত্বের শৃংখল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে বলি, নারীবিদ্বেষের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে বলি, নারীর সমানাধিকারের কথা বলি। আমাকে ধর্মান্ধ প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সহ্য হয় না। কিন্তু দেখলাম সরকারেরও সহ্য হয় না, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোরও হয় না। আমাকে ব্রাত্য করলো পশ্চিমবঙ্গ। পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ পৃথিবীর সবার জন্য অবারিত হলেও আমার জন্য নয়। শুধু আমি মানুষটা নই, আমার নামটাই, কারও, কোনও ব্যক্তির বা কোনও গোষ্ঠীর সইছে না আজকাল। নামটা শুনেই তারা ভয় পায়, কেটে পড়ে, এড়িয়ে যায়, মুখ ফেরায়, প্রসঙ্গ পাল্টায়। মুখ্যমন্ত্রী এই সেদিন কলকাতা বইমেলায় আমার বইয়ের উদ্বোধন নিষিদ্ধ করেছেন, টিভিতে আমার মেগাসিরিয়াল প্রচারের আগেই পুলিশ পাঠিয়ে বন্ধ করেছেন। এসব অন্যায় মুখ বুজে দেখে গেছে কলকাতা।
বাংলাদেশের বইমেলায় আমি নিষিদ্ধ আজ কুড়ি বছরেরও বেশি। পশ্চিমবঙ্গে নিষিদ্ধ আট বছর। একজন বাঙালি লেখক, যে লেখক বহুবার পুরস্কৃত হয়েছে, বাংলা ভাষায় চলি্লশটিরও বেশি বই লিখেছে যে বইগুলোর অধিকাংশই পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে- বাংলা ভাষার মূলভূমিতে বাংলা বইয়ের মেলায় তার প্রবেশের কোনও অধিকার নেই। আমি মানুষ খুন করিনি, কারও কোনও অনিষ্ট করিনি, নিঃসঙ্কোচে বলতে পারি আমার লেখা পড়ে অনেক স্ত্রী-পুরুষই সচেতন হয়েছে, নিজেদের ধর্মান্ধতা আর কুসংস্কার দূর করেছে, বিজ্ঞানমনস্ক হয়েছে, উদার আর সহিষ্ণু হয়েছে। অথচ আমার মত প্রকাশের অধিকারের বিরুদ্ধে দুই বাংলাই আজ সমান সরব। তবে কি আমার এ-ই দোষ যে, আমি সত্য কথা বলেছি? এমন কিছু সত্য আছে, যে সত্য বলতে হয় না, লোকে বলে না, বলে না কিন্তু আমি বলেছি?
স্রোতের বিরুদ্ধে গেলে বাকস্বাধীনতা হরণ করা হয়, বই নিষিদ্ধ করা হয়, বইমেলায় প্রবেশ বারণ করা হয়, লেখালেখি বন্ধ করে দেওয়া হয়, গৃহবন্দি করা হয়, নির্বাসন দেওয়া হয়। বাংলা থেকে আমার নির্বাসন হয়ে গেছে। যতদিন বাঁচি, এইটুকু বুঝেছি, বাংলার বাইরে আমাকে বাস করতে হবে। বাংলায় পা দেওয়ার কোনও অধিকারই আমার নেই।
ছোটবেলায় বইমেলা দেখার যে স্বপ্ন ছিল, সেই স্বপ্নটা আজও ফিরে ফিরে আসে। বইমেলায় না-যেতে-পারার কষ্ট পৃথিবীর সর্বসুখ দিয়েও আমি সামান্য কমাতে পারি না। একটু না-হয় অন্যরকম আমি। না-হয় একটু অন্যরকমই। অন্যরকমের কি অধিকার নেই এই সমাজে বাস করার! সবাই কি আর আপোস করে? সবাই কি আর হিসেব করে কথা বলে? কেউ কেউ তো থাকে সংসারে- যারা মিথ্যেকে মানে না, অন্যায়ের সঙ্গে, যা হয় হোক, আপোস করে না!
লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।