দুই মাসের বেশি সময় ধরে চলা অবরোধ ও হরতাল এবং সেই সঙ্গে সহিংসতা, অগ্নিদগ্ধ মানুষের যন্ত্রণা, অন্যদিকে ক্রসফায়ারের নামে মানুষ হত্যা এবং গণতন্ত্র হত্যা- দুইয়ে মিলে যে ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করছে, দেশবাসী তার থেকে পরিত্রাণ চায়। কিন্তু ভাবগতিক দেখে মনে হয় সহসা এই বিভীষিকা থেকে মুক্তি মিলছে না। এ পর্যন্ত পাওয়া তথ্য থেকে জানা যায়, গত দুই মাসে দুপক্ষের সহিংসতায় মারা গেছেন ১১৫ জন। তার মধ্যে পেট্রলবোমা ও আগুনে পুড়ে মারার সংখ্যা ৬২ জন। বন্দুকযুদ্ধ ও তথাকথিত গণপিটুনিতে মৃত্যু ৩৬ জন। সংঘর্ষ, \'গুলিবিদ্ধ লাশ\' ও \'সড়ক দুর্ঘটনায়\' ১৭ জন মৃত্যুবরণ করেছেন।
দুই বিবদমান পক্ষের মধ্যে যে সংঘাত চলছে তার সঙ্গে কিন্তু জনগণের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। বিরোধী পক্ষ হরতাল-অবরোধ চালিয়ে যেতে পারলেও জনগণকে রাস্তায় নামাতে পারেনি। হয়তো বলা হবে যে, বিরোধী দলকে তো শান্তিপূর্ণভাবে সভা-সমাবেশই করতে দেওয়া হচ্ছে না। রাস্তায় নামলেই তো গ্রেফতার। এমনকি ক্রসফায়ারের আশঙ্কাও আছে। এই অভিযোগের সত্যতা আছে। তবু বলব, জনগণের পক্ষের সত্যিকারের সংগ্রামী দল হলে তো প্রতিকূল পরিবেশেও মানুষ রাস্তায় নামতো। কিন্তু বিএনপি বা খালেদা জিয়ার জন্য মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কেন রাস্তায় নামবে? স্বচ্ছ নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে হয়তো নেগেটিভ ভোটে বিএনপির জেতার সম্ভাবনা ছিল। গত বছরের উপজেলা নির্বাচনের ফলাফল দেখে তাই মনে হয়। কিন্তু নির্বাচনে ভোট দেওয়া এক জিনিস আর জানবাজি রেখে রাস্তায় নামা আরেক জিনিস।
বিরোধী জোট দুই মাস ধরে অবরোধের পাশাপাশি হরতালও দিচ্ছে। এই হরতাল ডাকার একটা প্যাটার্ন তৈরি হয়েছে। প্রথমে রবিবার থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত ৭২ ঘণ্টা এবং তারপর আরও ৪৮ ঘণ্টা বর্ধিত করা হয়। মনে হয়, যেন তারা আন্দোলনের নামে তামাশা করছেন। এই তামাশার শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। ঢাকা শহরে হরতাল-অবরোধ কোনোটাই কার্যকরী নয়। ঢাকার বাইরে বোমাতঙ্কে হরতাল হচ্ছে। প্রধানত দূরপাল্লার যানবাহন দেখা যাচ্ছে না। এর ফলে কৃষকের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি হচ্ছে না। সাধারণ গরিব মানুষ দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কিন্তু জনগণের নাম নিয়ে রাজনীতি করা বিএনপি মানুষের ভালোমন্দ নিয়ে কবে ভেবেছে? বিগত ছয় বছরে বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় বিএনপি গরিব মধ্যবিত্তদের দাবি নিয়ে কোনো একটি সভাও করেনি। তাদের কোনো আর্থ-সামাজিক কর্মসূচিও নেই। এভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য অবরোধ ডাকা চরম দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় বহন করে।
অন্যদিকে সরকারও সমভাবে দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিচ্ছে। তারা রাজনৈতিক সংকটের কথা অস্বীকার করে মিথ্যাচার ও ফ্যাসিসুলভ আচরণ করে চলেছেন। একটি বিখ্যাত কথা আছে \'ট্রুথ ইজ দ্য ফাস্ট ক্যাজুয়েলিটি অব ওয়ার\' অর্থাৎ যুদ্ধে প্রথম যা বলি হয় তা হলো \'সত্য\'। বর্তমানে দুই বড় রাজনৈতিক দলের মধ্যে সেই সত্য নামক শব্দটি সবচেয়ে বেশি আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। প্রথমে দেখা যাক, বিরোধীপক্ষ কিভাবে মিথ্যাচার করেছে। ছয়জন মার্কিন কংগ্রেসম্যানের নামে যুক্তরাষ্ট্রের বিএনপি নেতারা যে জাল বিবৃতি দিয়েছিলেন তা দলটির চরম দেউলিয়াত্ব প্রমাণ করে। প্রথমত, মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ। দ্বিতীয়ত, বিদেশ-নির্ভরতা। একইভাবে ভারতের শাসক দল বিজেপি সভাপতি অমিত শাহর সঙ্গে ফোনালাপ নিয়েও সংশয় আছে।
এ ধরনের মিথ্যা বিবৃতির উদ্দেশ্য কি? জনগণ এবং হতাশ হয়ে যাওয়া দলের কর্মীদের আশ্বাস দেওয়া যে, বিদেশি রাষ্ট্রসমূহ আমাদের সঙ্গে আছে। জনগণের ওপর আস্থা থাকলে বিদেশিদের দিকে তাকাতে হয় না। বিদেশ-নির্ভরতা শাসক দল আওয়ামী লীগ এবং জোট সরকারেরও বৈশিষ্ট্য। একই সঙ্গে তারা সত্যের অপলাপ করে চলেছেন অবলীলাক্রমে। কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যাক। প্রথম দেখা যাক তারা বিরোধী দলকে দমনের জন্য কি ধরনের নিকৃষ্ট কৌশল গ্রহণ করেছেন এবং একই সঙ্গে সত্যের অপলাপ করে চলেছেন। ক্রসফায়ার বা বন্দুক যুদ্ধের নামে মিথ্যা নাটক সাজানোর ব্যাপারটি তো বেশ পুরনো। এখন তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গণপিটুনির নামে বিচার-বহির্ভূত হত্যা। গত ২২ ফেব্রুয়ারি রাতে মিরপুরের কাজীপাড়ায় তিন তরুণ গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন বলে পুলিশের পক্ষ থেকে প্রচার করা হয়। তারা নাকি নাশকতামূলক কাজ করার সময় হাতেনাতে ধরা পড়েন এবং গণপিটুনিতে নিহত হন। কিন্তু পরদিনই পুলিশের সুরতহাল প্রতিবেদনে দেখা যায় তিনজনের দেহে অন্তত ৫৪টি গুলি রয়েছে। এমনকি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান পর্যন্ত মন্তব্য করেছেন \'আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের হাতে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে যা দেখে মনে হয় তারা ক্ষমতার অতিরিক্ত ব্যবহার করেছেন। এ ক্ষেত্রে এমন কয়েকটি ঘটনাও ঘটেছে। অনেক সময় বন্দুক যুদ্ধের পর নিহত ব্যক্তির পাশে পেট্রলবোমা রাখা হচ্ছে।\' (বাংলাদেশ প্রতিদিন-৬ মার্চ ২০১৫)
ইতিপূর্বেও আমরা দেখেছি খালেদা জিয়ার কার্যালয় তালা মেরে বলা হচ্ছে যে তিনি অবরুদ্ধ নন। বালুর ট্রাক দিয়ে অবরুদ্ধ করার পরও জনৈক মন্ত্রী বলেছেন, বাড়ি মেরামত করার জন্য বালুর ট্রাক রাখা হয়েছে। এ সবই নিকৃষ্ট ধরনের মিথ্যাচার। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নিকৃষ্ট ধরনের কৌশল। যথা বিদ্যুতের সংযোগ কেটে দেওয়া, অথবা বাইরে থেকে খাবার আনতে না দেওয়া। এসব কর্মকাণ্ড অতি নিকৃষ্ট সাংস্কৃতিক মান ও রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের পরিচয় বহন করে। বিবদমান দুদল যে ধরনের অতি নিম্নরুচি ও সংসৃ্কতির পরিচয় দিয়েছে তাতে বিশ্বের কাছে আমরা বড় ছোট হয়ে গেছি।
বিশ্বের কাছে আমরা যে কত ছোট হয়েছি তার আরেকটি উদাহরণ দেওয়া যাক। কিছু দিন আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মানবাধিকার বিষয়ক এক কমিটির নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির ব্যাপারে তারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মিথ্যাচার করে দাবি করল, তারা নাকি কোনো উদ্বেগ প্রকাশ করেননি। অর্থাৎ জনগণকে বোঝানো হয়েছে, বিদেশিরা সরকারের সঙ্গে আছে। বিদেশ-নির্ভরতা ও মিথ্যাচারের আরেকটি দৃষ্টান্ত। কিন্তু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বক্তব্যকে খণ্ডন করে সেই কমিটির নেতা ঢাকায় বসেই বললেন, \'উদ্বিগ্ন বলেই তো বাংলাদেশে এসেছি\'। দেশের মানসম্মান সবটাই এভাবে ভূলুণ্ঠিত হয় সত্যের অপলাপকারী ও অর্বাচীন সরকারের কারণে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আগেরকার বক্তব্যের সংশোধনী আনতে বাধ্য হয়েছিলেন। এমন ঘটনা নজিরবিহীন।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর যে বৈঠক হয় সেখানে কি আলোচনা হয়েছিল তা নিয়েও সরকার অর্ধসত্য বলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক সংকট নিরসনের জন্য বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনার আহ্বান জানানো হয়েছিল। কিন্তু সরকারি ভাষ্যে সে কথা বেমালুম চেপে যাওয়া হয়েছিল। বিরোধীপক্ষ যেমন দেখাতে চায়, বৈদেশিক শক্তি তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল, তেমনি সরকারও আশ্বাস দিতে চায়, বিদেশিদের কোনো চাপ নেই, তারা নাকি সবাই ৫ জানুয়ারির নির্বাচন মেনে নিয়েছে।
এদিক দিয়ে সরকারের মন্ত্রী ও সরকারি দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম অনেক বেশি স্পষ্টভাষী। তিনি মার্কিন সহকারী মন্ত্রীকে দুই আনার মন্ত্রী বলে উপেক্ষা ও তাচ্ছিল্য করতে পেরেছেন। এমনকি রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক শিষ্টাচারের তোয়াক্কা না করে ঢাকায় অবস্থিত মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে (সদ্য বিদায়ী ড্যান মোজীনা) বাসার কাজের মেয়ের সঙ্গে তুলনা করেছেন। ভাবখানা দেখে মনে হয়, সরকার যেন হঠাৎ করে বামপন্থি হয়ে গেছে। তবে বামপন্থি ও কমিউনিস্ট কোনো নেতা সত্যিকার অর্থে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও এমন ভাষা ব্যবহার করবেন না। কারণ এটা সাধারণ সৌজন্যবোধের পরিপন্থী। সরকারের আরেক মন্ত্রী বলে গেলেন, পাকিস্তান দূতাবাসে তালা লাগানো হবে। মন্ত্রীদের কথাবার্তায় কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। পাকিস্তান একটি প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্র। ১৯৭১ সালে আমি যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলাম, সেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। তথাপি বঙ্গবন্ধু নিজেই পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। সেই কূটনৈতিক সম্পর্ক অব্যাহত থাকা অবস্থায় কি কোনো মন্ত্রী তাদের দূতাবাসে তালা লাগানোর ঘোষণা দিতে পারেন? বাংলাদেশ এক আজব দেশে পরিণত হয়েছে।
হয়তো মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের দুই নম্বর শীর্ষ নেতা সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে ঘৃণা ও ক্ষোভ এতটাই বেশি যে, তিনি ভদ্রতার তোয়াক্কা করেননি। আমি তাকে শাবাশ দিতাম যদি না সরকারের আরেক মন্ত্রী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াশিংটনে ছুটে যেতেন মার্কিন প্রশাসনকে তুষ্ট করার জন্য। সরকার যে তড়িঘড়ি করে বঙ্গোপসাগরের তিনটি গ্যাস ক্ষেত্র মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানির হাতে তুলে দিয়েছে সেটিও দৃষ্টির বাইরে রাখা যাবে না।
মোট কথা সরকার ও বিরোধী পক্ষ উভয়ই মিথ্যাচার এবং বিদেশ-নির্ভরতার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছে। এখন যে রাজনীতি চলছে তা হচ্ছে সহিংসতা-নৃশংসতা গণতন্ত্র হরণ এবং তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মিথ্যাচার ও বিদেশ-নির্ভরতা। এটি সামগ্রিকভাবে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের চরম দেউলিয়াত্ব প্রমাণ করে। তাই রাজনৈতিক সংকটও নিরসন হচ্ছে না। আমি জানি না এই রাজনীতি দেশকে কোথায় নিয়ে যাবে।
তবু আশা রাখব। আশা করব, সব পক্ষের শুভবুদ্ধির উদয় হবে। বিরোধীপক্ষ অবরোধ প্রত্যাহার করে সন্ত্রাসী রাজনীতি থেকে নিজেকে সরিয়ে নেবে। সরকারও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বন্ধ করে গণতন্ত্রের পথে আসবে। গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগের সুযোগ করে দেবে। ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ বন্ধ হবে। বিরোধী দলের নেতারা মুক্ত হবেন এবং আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সংকট সমাধানের পথ খুঁজবেন। জোর করে ক্ষমতা অাঁকড়ে থাকার অপচেষ্টা থেকে বিরত হবেন। এই যে আশাবাদ সেটা কেবল আমার না, প্রতিটি গণতন্ত্রকামী শান্তিপ্রিয় মানুষেরই মনের কথা। কিন্তু আশাবাদ যদি ব্যর্থ হয় তাহলে সামনে যে দুর্দিন আসবে তা ভাবতেও শঙ্কিত হচ্ছি। আশঙ্কা হয়, এই সংকটের মাঝখান দিয়ে মৌলবাদ আরও হিংস্র জঙ্গিরূপে আত্দপ্রকাশ করবে। আর সরকারও আরও ফ্যাসিবাদী রূপ পরিগ্রহ করবে।
তাহলে ভরসার জায়গা কোথায়? শেষ ভরসার জায়গা জনগণ। এই জনগণ উভয়পক্ষকে পরিত্যাগ করে নতুন গণতান্ত্রিক শক্তির অভ্যুদয় ঘটাবে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন \'মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ\'। সেই বিশ্বাস আমিও এই দেশের মানুষের ওপর রাখতে চাই।