সময়কাল ১৯৯২। অ্যান্টি- প্রগতিশীল শিবিরের একজন ও তার সমালোচনাকারীর মধ্যে উত্তেজনাপূর্ণ বাক্য-বিনিময়ের শেষ ধাপ।
অ্যান্টি-প্রগতিশীল শিবির : (উত্তেজনায় ফুঁসতে ফুঁসতে) আপনি আল্লায় বিশ্বাস করেন?
সমালোচক : হ্যাঁ।
অ্যান্টি-প্রগতিশীল শিবির : তাহলে কোনো ‘কিন্তু’ ‘যদি’ বলবেন না। যেটা বলছি, শোনেন।
সময়কাল ২০১৪।
প্রগতিশীল শিবিরের একজন ও তার সমালোচকের মধ্যে উত্তেজনাপূর্ণ বাক্যবিনিময়ের শেষ ধাপ।
প্রগতিশীল শিবির : (উত্তেজনায় ফুঁসতে ফুঁসতে) আপনি মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাস করেন?
সমালোচক : হ্যাঁ।
প্রগতিশীল শিবির : তাহলে কোনো ‘কিন্তু’ ‘যদি’ বলবেন না। যেটা বলছি, শোনেন।
(যদিও এই প্রগতিশীল ও ‘অ্যান্টি-প্রগতিশীল শিবির’ এই ট্যাগ দুইটা আমার একদমই পছন্দ না। তবুও বোঝার সুবিধার জন্য ব্যবহার করলাম।)
দুইটা ঘটনাই সত্য। দুইটা ঘটনাতেই দেখতে পাচ্ছি ‘কিন্তু’ এবং ‘যদি’ এই দুটি শব্দের উপর ভীষণ গোস্বা। আমরা জানতাম ধর্মান্ধরা ‘কিন্তু’ এবং ‘যদি’তে ভয় পায়। কবে থেকে এই ভয় আমাদের ‘প্রগতিশীল শিবিরে’ও হানা দিল? আমরা যদি সত্য সত্যই একটা জ্ঞানভিত্তিক প্রগতিশীল সমাজ চাই তাহলে ‘কিন্তু’ ‘যদি’ ঝেটিয়ে বিদায় করে সেটা কিভাবে সম্ভব? ‘কিন্তু’ এবং ‘যদি’ দিয়ে দ্বিমত এবং প্রশ্নের সূচনা হবে। যে প্রশ্ন আমাদের সামনের রাস্তা দেখাবে। আমরা তবে এই শব্দগুলোতে অ্যালার্জিক হব কেন? আমরা তো ন্যায়ের পথে আছি, প্রশ্নে কেন হব হতবিহ্বল? আমি বড় হয়েছি নাখালপাড়ায়। নাখালপাড়ার হৃদয় তার শারীরিক আয়তনের চেয়েও বড়। চোর-পুলিশ আওয়ামী লীগ-বিএনপি, আস্তিক-নাস্তিক, নামাজি-বেনামাজি, প্রেমিক-ধর্ষক, সত্যবাদী-চাঁপাবাজ, ব্যায়ামবীর-নেশাখোর এরকম এইরকম বিচিত্র জাতের মানুষকে পরম মমতায় তার সদর দরজায়, কাছারিঘরে, শয়নকক্ষে, বারান্দায়, ঘুলঘুলিতে ঠাঁই দিয়েছিল নাখালপাড়া। আমরা বেড়েও উঠেছি এইসব বিচিত্র মানুষের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। আওয়ামী লীগের নেতার ছেলে বিএনপির নেতার মেয়েকে বিয়ে করছে। মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে এসে নামাজি মোড়ের দোকানে দাবা খেলতে বসে গেছে বেনামাজির সঙ্গে। এক কেতলির চা ভাগ করে খাচ্ছে হাবিল-কাবিল। মোড়ের দোকানে আস্তিক আর নাস্তিকের যুক্তির লড়াই কখনো সৌজন্যবোধ আর রস হারিয়ে মারামারিতে পর্যবসিত হতে দেখিনি। নাস্তিক তার অবিশ্বাসের দর্শন আর তার পেছনে যুক্তি তুলে ধরলেও আস্তিককে ‘গাধা’ বা ‘বেকুব’ বলে আক্রমণ করেনি। তেমনি আস্তিকও শবে বরাতের বিশেষ খাবারে নাস্তিক বন্ধুটিকে দাওয়াত দিতে ভুলে যায়নি, তরবারি নিয়ে কতল করতে যাওয়া তো দূরের কথা। বিএনপি নেতাকে মামলা খেয়ে আওয়ামী লীগ নেতার বাসায় লুকাতে দেখেছি। সব বিরোধ, দ্বিমত, বিশ্বাসের বৈপরীত্য নিয়েও তাই ‘আমরা’ সবাই ছিলাম ‘আমরা’। আজকে আমরা তথ্য এবং জ্ঞানে আরও এগিয়ে গেছি। কিন্তু কোন অলক্ষ্যে যেন আমাদের সমাজের সহনশীলতা আর মায়ার সুতাটা খসে পড়ে যাচ্ছে। এখানে যেন দ্বিমত বা বহুমত আর স্বাগত নয়। ও না, ঠিক বললাম না। এখানে এখনো ‘দ্বিমত’কে স্বাগত জানান হয় কেবল যদি কেউ নাজুক অবস্থায় পড়েন। সরকার যখন বিরোধী দলকে অত্যাচার করে কিংবা কথা বললেই মার দেয়, তখন ‘অ্যান্টি-প্রগতিশীল শিবির’র লোকজন বহুমত এবং বহুত্ববাদী সমাজের পক্ষে দাবি তোলেন। কিন্তু অন্য সময় তারা ভীষণ বৈচিত্র্যবিরোধী।
আর ধর্মান্ধরা যখন অবিশ্বাসীকে খুন করে তখন প্রগতিশীল শিবির এক বহুত্ববাদী সমাজের দাবি তোলেন। কিন্তু বিরোধী দলের কণ্ঠ যখন রোধ করা হয় তখন প্রগতিশীল শিবির বহুত্ববাদিতার প্রয়োজন দেখেন না। যেন তারা ধরেই নিয়েছেন আমাদের পক্ষের সরকার আজীবন ক্ষমতায় থাকবেন। তারা মনে রাখেন না প্রগতিশীলরাও এক সময় বিরোধী দলে যাবেন এবং তখন ‘অ্যান্টি-প্রগতিশীল শিবির’র লোকজন আজকের চেয়েও কঠিনভাবে দমন-পীড়ন চালাতে পারে। যাই হোক কথা হলো, বহুত্ববাদ আমাকে যখন সুবিধা দেয় তখন আমি এটার পক্ষে, আর যখন আমার বিরুদ্ধে যায় তখন আমি এর প্রয়োজনীয়তা দেখি না। আমাদের এখানে তাই বহুত্ববাদ ভাগ হয়ে গেছে, মানবিকতা ভাগ হয়ে গেছে, দুঃখ ভাগ হয়ে গেছে। আমাদের এক দলের দুঃখ বরাদ্দ পেট্রলবোমায় পোড়া মানুষের জন্য, আরেক দলের দুঃখ বরাদ্দ রাষ্ট্রশক্তির সন্ত্রাসে মৃত্যুবরণ করা বা গুম হয়ে যাওয়া মানুষের জন্য।
আমি জানি পৃথিবীর কোনো সমাজ কোনোকালেই আদর্শ কিছু ছিল না। প্রত্যেক সমাজ এবং প্রত্যেক কালেরই নিজস্ব কিছু চাঁদের দোষ থাকে। সেইসব দোষ নিয়েও সমাজ এগিয়ে যায় যদি সহনশীলতার মাত্রাটা উপরের দিকে থাকে। নাখালপাড়ায় আমার বেড়ে ওঠার সময়ের গল্প শুনে যেন আবার মনে না করেন যে আমাদের নাখালপাড়া ছিল রূপকথার বই থেকে পেড়ে আনা এক স্বপ্নপুরী। সেখানে মারামারি ছিল, খুনাখুনি ছিল, এক নম্বর-দুই নম্বর সব রকম কাজই ছিল। একজনের জুটের ব্যবসা আরেকজন টান দিলে মারামারি বেধে যেত। এর ব্যবসা ও খেয়ে ফেললে বা ব্যবসার পথে কাঁটা হলে খুনাখুনি লেগে যেত। কিন্তু ‘তুমি আমার বিশ্বাসে বিশ্বাসী না হলে, আমার দল না করলে, আমার মত তোমার মতের সঙ্গে না মিললে তোমাকে নির্মূল করব’- এই সংস্কৃতি আমি দেখিনি। আজকের বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সামনে যে বিপদটা আমি দেখি সেটা হচ্ছে ‘বহুত্ব নির্মূল অভিযান’। বহু রকম মানুষ, বহু রকম চিন্তা, বহু রকম খাদ্যাভ্যাস, বহু রকম যৌনাভ্যাস- এগুলো এখানে সহ্য করা হবে না এবং এই বহুত্ব ধ্বংস অভিযানে বুদ্ধিজীবী-অবুদ্ধিজীবী, প্রগতিশীল-পশ্চাদমুখী সবাই একই শ্রেণির টিকিট হাতে পেয়েছেন। একই জোশে ‘তারা’ সবাই ‘অন্যকে’ হটিয়ে দেওয়ার অভিযানে নেমেছেন। তারা সবাই এক ‘মহৎ’ যুদ্ধে অবতীর্ণ আছেন। প্লিজ, তাদের ডেকে বিরক্ত করবেন না। এই ছোট জীবনে (বেশি ছোটও না আবার) আমি বহু ওস্তাদের সান্নিধ্য পেয়েছি। তাদের মধ্যে একজন কবি বেলাল চৌধুরী। তাকে আমি দ্বিতীয় পিতা বলি। তার সঙ্গে আমার যখন প্রথম আলাপ তখন তিনি ভারত বিচিত্রায় চাকরি করেন। আমি বেকার। প্রতিদিন দুপুরে তার সঙ্গে আড্ডা এবং দুপুরের খাবারের লোভে তার ওখানে যাই। যারা তার আড্ডায় গিয়েছেন তারা জানেন ওই একেকটা আড্ডা বিশ্ববিদ্যালয়ের একেকটা ক্লাসের চেয়েও বেশি তথ্য এবং জ্ঞানবহুল। সেইরকম এক আড্ডায় তিনি বলেছিলেন, ‘সরয়ার, জ্ঞান মানুষকে কেন বিনয়ী করে জান? কারণ জ্ঞান মানুষকে আরও সন্ধিহান করে তোলে। জ্ঞানী মানুষ আর যাই বোঝেন না বোঝেন এটা বোঝেন যে জগতে কোনো কথাই শেষ কথা নয়, কোনো সত্যই শেষ সত্য নয়।’ আজকে আর মনে নেই কোন প্রসঙ্গে এটা বলেছিলেন। তবে এই কথাটা আমার মাথায় খুব বেজে ওঠে যখন আজকে চারপাশে একদল ‘নিশ্চিত’ মানুষ দেখি। এখানে কোনো সন্ধিহান মানুষ নেই। প্রত্যেকেই নিশ্চিত তার মত, তার পথ, তার বিশ্বাসই সঠিক। শুধু তারটা সঠিক ভাবলেও অবস্থা এত গুরুতর হতো না। অবস্থা গুরুতর পর্যায়ে পৌঁছেছে কারণ তিনি নিশ্চিত হয়েছেন ‘অন্যদের’ মত-পথ- বিশ্বাস পুরোটাই বেঠিক এবং তার ওপর ঈশ্বর-প্রেরিত বা জাতীয়তাবাদ উৎসারিত মহৎ দায়িত্ব বর্তেছে ‘অন্যকে’ হটানোর, বাতিল করার, নির্মূল করার। এই অবস্থা আরও জটিল হয়েছে যখন এই নির্মূল তত্ত্ব এবং সংস্কৃতির গোড়ায় জ্ঞানের পানি ঢালার জন্য আবির্ভূত হয়েছে দুই দল বুদ্ধিজীবী। তারা প্রত্যেকেই যার যার তরিকা অনুযায়ী তত্ত্ব তৈরি এবং সম্প্রচার করছেন। সাধারণত মানুষ যুক্তি দিয়ে সত্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করে। আমাদের এখানে এখন দুই মেরুর বুদ্ধিজীবীরাই আগে ‘সত্য’ স্থির করে নেন। তারপর সেখানে পৌঁছানোর জন্য যুক্তির মই তৈরি করেন নিপুণ কার্পেন্টারের দোকানে। এইরকম মইবহুল সমাজ যুক্তিবাদী, দরদী এবং বিচক্ষণ মানুষ উৎপাদনে বাধা দেয়। আমাদের তরুণ প্রজন্মের হাজার সম্ভাবনা। আমাদের শিশু-কিশোররা তাদের চেয়েও বেশি সম্ভাবনাময়। আসুন আমরা তাদের একটা দরদী সৃজনশীল সমাজ উপহার দিই, একটা ‘কিন্তু-যদি’ওয়ালা সমাজ উপহার দিই।
লেখক : চলচ্চিত্র নির্মাতা।