ইরানে তখন বিপ্লবের সুর বাজছে জনতার প্রাণে-প্রাণে। মোহাম্মদ রেজা শাহ পাহলভীর দীর্ঘদিনের রাজত্ব শেষ করে আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে ক্ষমতা দখলের মাঠ প্রস্তুত করছে বিপ্লবীরা। ইরানের এই বিশৃঙ্খল অবস্থার সঙ্গে মিল ছিল ১৯৭৮ সালের বিশ্বকাপ আয়োজক আর্জেন্টিনারও। সন্ত্রাসবাদী দল 'মন্টোনেরস' পুরো আর্জেন্টিনায় ত্রাসের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল। স্বৈরশাসক জেনারেল জর্জ রাফায়েল ভিদেলা নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিলেও ১৫টি দলের সদস্যরা দুরু দুরু মন নিয়ে বিশ্বকাপের মঞ্চে হাজির হয়। এর মধ্যেই হিশমাত মুহাজিরানির অধীন ইরানি দল নিজেদের প্রথম বিশ্বকাপ খেলতে বুয়েন্স আয়ার্সে পৌঁছে। দক্ষিণ কোরিয়া, উত্তর কোরিয়া এবং ইসরায়েলের পর চতুর্থ এশিয়ান দল হিসেবে ইরান বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে অংশ নেয়।
আর্জেন্টিনায় বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বে তাদেরকে খেলতে হয় আগেরবারের রানার্সআপ নেদারল্যান্ড, ল্যাটিন শক্তি পেরু এবং স্কটল্যান্ডের সঙ্গে। শক্তিশালী এই গ্রুপে খেলেও শেষ পর্যন্ত এক পয়েন্ট নিয়ে বাড়ি ফিরেছিল ইরান। প্রথম ম্যাচে নেদারল্যান্ডের কাছে ৩-০ গোলে পরাজয় স্বীকার করেন হিশমাতের শিষ্যরা। তবে দ্বিতীয় ম্যাচেই ইতিহাস গড়ে তারা। দুর্দান্ত প্রতিপক্ষ স্কটল্যান্ডের সঙ্গে ১-১ গোলে ড্র করে। ম্যাচে জয় নিয়েই মাঠ ছাড়তে পারতো ইরান। সেন্টার ব্যাক এস্কান্দারিয়ার আত্দঘাতী গোলেই বেঁচে যায় সেই বিশ্বকাপেই নেদারল্যান্ডকে ৩-২ গোলে হারিয়ে দেওয়া স্কটল্যান্ড। এই ম্যাচ নিয়ে অনেক বিতর্ক ছিল। স্কটিশ ফুটবলার উইলি জনস্টন এবং কেলি ডালগলিশের বিপক্ষে ডোপ গ্রহণের অভিযোগ উঠে। শেষ পর্যন্ত জনস্টনকে আজীবন নিষিদ্ধ করেছিল ফিফা।
আর্জেন্টিনার মাটিতে বিশ্বকাপটা ঠিকঠাক শুরু করলেও পরবর্তী বিশ্বকাপ খেলার জন্য বিপ্লবী ইরানকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত। ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত সে বিশ্বকাপে ১৯৯৪ বিশ্বকাপের আয়োজক যুক্তরাষ্ট্রকে ২-১ গোলে হারিয়ে বিশ্বকাপের মঞ্চে প্রথম জয় পেয়েছিল ইরান। ২০০৬ সালেও বিশ্বকাপের মঞ্চে হাজির হয়েছিল এশিয়ার এই শক্তিশালী প্রতিনিধি। জার্মানিতে অনুষ্ঠিত সে বিশ্বকাপে ইরানের একমাত্র অর্জন ছিল অ্যাঙ্গোলার সঙ্গে ১-১ গোলে ড্র।
আরও একটি বিশ্বকাপের মঞ্চে হাজির ইরান। ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বে ইরান মুখোমুখি হবে আর্জেন্টিনা, বসনিয়া-হার্জেগোভিনা এবং নাইজেরিয়ার। এশিয়ার যে কোনো দলের জন্যই গ্রুপটা কঠিন। তবে পর্তুগালের সাবেক কোচ কার্লোস কুইরোজের অধীন ইরান পুরোপুরিই বদলে গেছে। দলটার কোচিং স্টাফের প্রায় পুরোটাই পর্তুগিজ! গত মার্চে গিনির কাছে ২-১ গোলে পরাজয় স্বীকার করার আগে তারা টানা সাতটা ম্যাচ জিতেছে। জাভেদ নিকোনামের নেতৃত্বে ইরানি দল বিশ্বকাপের পুরনো মঞ্চে নতুন রূপেই আবির্ভূত হচ্ছে। নাইজেরিয়া এবং বসনিয়া-হার্জেগোভিনা তো বটেই এমনকি দুইবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনার সঙ্গেও ইরানিরা পচা শামুকের মতোই আচরণ করতে পারে। বিশ্বকাপ বাছাই পর্বে এশিয়ান ফুটবলের প্রধান শক্তি দক্ষিণ কোরিয়াকে টপকে শীর্ষে থেকে বিশ্বকাপ নিশ্চিত করার বিষয়টাই কি ইরানের শক্তিমত্তা প্রকাশ করছে না! এশিয়ানদের জন্য সর্বোচ্চ সেমিফাইনাল খেলার আনন্দ এনে দিয়েছিল দক্ষিণ কোরিয়া ২০০২ সালে। নতুন যুগের সূচনায় ইরান হতে পারে এশিয়ান ফুটবলের মশালবাহী। ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে নতুন কোনো ইতিহাসের সৃষ্টি করবে কি বদলে যাওয়া এই ইরান! নাকি আরও একবার গ্রুপ পর্বেই থেমে যাবে তাদের রথযাত্রা!