জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের পাশেই তখন মোহামেডান ক্লাব। আগের দিন আবাহনীর বিপক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ থাকাতে রাতে আমি ক্লাবেই ছিলাম। সকালবেলায় ঘুম থেকে উঠেই দেখি ক্লাবের সামনে হাজার হাজার দর্শকদের ভিড়। সবারই ভেতর একটা দুশ্চিন্তার ছাপ খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। সত্যি বলতে কি নার্ভাসে রাতে আমরা খেলোয়াড়রা সঠিক মতো ঘুমাতে পারেনি। কারণ বিকালে আমাদের সঙ্গে ড্র করতে পারলেই টানা চারবার লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়ে দেশের ফুটবলে আবাহনী আরেকটি ইতিহাস গড়ে ফেলবে। এমনিতেই তারা তিনবার চ্যাম্পিয়ন হওয়াতে সমর্থকরা আমাদের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। আর এটাই স্বাভাবিক ১৯৮২ সালের পর আমরা তিন বছর লিগে চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি। ১৯৮৬ সালে সুপার লিগে মোহামেডান-আবাহনীর লড়াইয়ে কথা বলছিলাম। বলে রাখা ভালো এটাই দুদলের শেষ ম্যাচ ছিল না। আমাদের শেষ ম্যাচ ওয়ান্ডারার্স। আর আবাহনীর বাকি ছিল ব্রাদার্স ইউনিয়নের সঙ্গে লড়াই। তবে দুই চির প্রতিদ্বন্দ্বীর লড়াইয়ে যে জিতবে তারাই শিরোপা নিশ্চিত করবে। আমাদের চেয়ে ১ পয়েন্ট এগিয়ে থাকাতে আবাহনীর ড্র করলেই চলত। আর মোহামেডানকে জিততেই হবে।
মোহামেডান দলে সেবার আমি ও মহসিন গোলরক্ষক। কোচ আলী ইমাম ভাই আগের দিনই বলে দিলেন ম্যাচে কানন গোলরক্ষকের দায়িত্ব পালন করবে। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরই ইমাম ভাই আমাকে হাল্কা অনুশীলন করালেন। বললেন কানন আজ কোনো অবস্থাতেই ভুল করা যাবে না। আত্দবিশ্বাস ছিল জিতবো কিন্তু ওই ম্যাচে জয় নিশ্চিত করতে আবাহনী ভারত থেকে মনোরঞ্জনধর, ভাস্কর গাঙ্গুলি ও নাইজেরিয়ার চিমা ওকোরিকে উড়িয়ে আনে। তিনজনই ভয়ানক খেলোয়াড়। সুতরাং আত্দবিশ্বাসের মধ্যেও ভেতরে ভেতরে ভয় কাজ করছিল। মন একটু হাল্কা করতে স্টেডিয়াম আঙ্গিনায় হাঁটতে গেলাম। অবস্থা দেখতো অবাক হয়ে গেলাম। বিকালে ম্যাচ অথচ ১১টা থেকেই স্টেডিয়ামে হাজার হাজার দর্শকদের ভিড়। দর্শকদের কথা চিন্তা করে দুপুর একটা থেকেই স্টেডিয়ামের গেট খুলে দেওয়া হয়। আর তিনটার মধ্যে পুরো গ্যালারি ভরপুর। ওই ম্যাচে মোহামেডান ইলিয়াস ও মনুর দেওয়া ২ গোলে জয়লাভ করে। পরের ম্যাচে আমরা ওয়ান্ডারার্সকে ৪-২ গোলে হারিয়ে লিগ শিরোপা উদ্ধার করি। আমার বিষয় ফলাফল নয় দর্শক। তখন শুধু ওই ম্যাচে নয় মোহামেডান-আবাহনী ম্যাচ হলে পুরো দেশই উত্তেজনায় কাঁপত। কষ্ট লাগল বুধবার গ্যালারির দৃশ্য দেখে। স্বাধীনতা কাপে ফাইনাল উঠতে লড়ছে দুই দল। অথচ গ্যালারির কি করুণ হাল। বেশ কয়েক বছর ধরে ফুটবলে দর্শক খরা চলছে। মোহামেডান-আবাহনী ম্যাচে এমন করুণ হাল হবে তা জীবনেও কল্পনা করতে পারেনি। কথা হচ্ছে কেন এমন হবে? অনেকে বলেন, মান নেই বলে দর্শকরা ফুটবলে ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। এটা ঠিক মান অনেক কমে গেছে। কিন্তু অমরা যখন খেলতাম তখনওতো আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আহামরি কিছু করতে পারিনি। তবে ঘরোয়া ফুটবলে মানসম্পন্ন ফুটবলারের অভাব ছিল না। এখন দেশে নতুন কোনো ফুটবলারই বের হয়ে আসছে না। বের হবে কি, একমাত্র ঢাকা ছাড়া দেশের অন্য কোথাও নিয়মিত ফুটবলই হয় না। বলতে লজ্জা লাগছে এখন মোহামেডান-আবাহনীতে যারা খেলেন তাদের অনেককে আমিই চিনি না। অথচ আগে সাইড বেঞ্চে যারা বসে থাকতেন তাদের নামও দর্শকদের মুখস্ত ছিল। দর্শক না হওয়ার এটাও বড় কারণ। ফুটবল জাগাতে ফুটবল ফেডারেশনের দায়িত্ব অনেক। তারা ব্যর্থ বলেই বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলার এ পরিণতি। জানি না আর কখনো ঘরোয়া ফুটবলে গ্যালারিভরা দর্শক দেখা যাবে কিনা। সত্যিই আবাহনী-মোহামেডানের ম্যাচের এই অবস্থা দেখে মনটা আবারও খারাপ হয়ে গেছে।