আজ পয়লা বৈশাখ। বাঙালির প্রাণের উৎসব। এই সর্বজনীন উৎসবের অন্যতম বর্ণিল আয়োজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের আনন্দ শোভাযাত্রা। স্বৈরাচার পালিয়ে যাওয়ার পর এবারের শোভাযাত্রা ঘিরে শিল্পাঙ্গনের মানুষের রয়েছে ভিন্ন রকমের আগ্রহ। ’২৪-এর চেতনাকে ধারণ করে নতুন বাংলাদেশের এবারের শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান’। এ শোভাযাত্রা আয়োজনের সঙ্গে সম্পৃক্তদের কথা জানাচ্ছেন - মোস্তফা মতিহার
শোভাযাত্রায় মুঘল ও সুলতানি আমলের শিল্পকর্ম
এবারের শোভাযাত্রায় স্থান পাচ্ছে মুঘল ও সুলতানি আমলের শিল্পকর্ম। শোভাযাত্রা উদযাপন পরিষদের আহ্বায়ক ও চারুকলা অনুষদের ডিন আজহারুল ইসলাম চঞ্চল বলেন, মুঘল সম্রাট আকবরের হাত ধরেই বাংলা নববর্ষ উদযাপন শুরু হয়। আমরা মুঘল মিনিয়েচার তুলে ধরার চেষ্টা করছি মুঘল ও সুলতানি আমলের শিল্পকর্মের বিষয়বস্তুতে। সেই সময়কার শিল্পকর্মের সঙ্গে এই সময়কার শিল্পকর্মের মেলবন্ধন ঘটানোর জন্যই এবার মুঘল মিনিয়েচার রাখা হয়েছে। পয়লা বৈশাখ মূলত বাঙালির লোকজ সংস্কৃতির অংশ। এখানে বাঘ, হাতি, হরিণ, পেচাসহ বিভিন্ন ধরনের মুখোশ থাকে। এগুলো আবহমান বাংলা সংস্কৃতির অংশ। তবে, অন্যান্য বছর ফ্যাসিবাদের আমলে মঙ্গল শোভাযাত্রা অতিমাত্রায় রাজনৈতিক প্রভাবে প্রভাবিত থাকলেও এবারের শোভাযাত্রায় সে সব থাকছে না। চব্বিশের চেতনা ধারণ করে সমকাল, ইতিহাস, ঐতিহ্যকে মাথায় রেখে এবারের আনন্দ শোভাযাত্রার পরিকল্পনা সাজানো হয়েছে। শোভাযাত্রায় পাঁচটি বড় মোটিফের পাশাপাশি সমকালীন বিভিন্ন বিষয়ের ছোট-বড় নানা মোটিফ যুক্ত থাকছে। থাকবে ঐতিহ্যবাহী পালকি, পাখা, সুলতানি আমলের মুঘল মিনিয়েচারভিত্তিক মুখোশ।
এবার সবচেয়ে বর্ণিল ও সর্বজনীন শোভাযাত্রার প্রত্যাশা
আনন্দ শোভাযাত্রা উদযাপন পরিষদের সদস্যসচিব হিসেবে ব্যস্ত চারুকলা অনুষদের অধ্যাপক এ এ এম কাওসার হোসেন টগর। তার সুনিপুণ দক্ষতায় এগিয়েছে বিশাল কর্মযজ্ঞ। এবারের শোভাযাত্রা নিয়ে অনেক ধরনের অপপ্রচার চালাচ্ছে একটি গোষ্ঠী। অধ্যাপক এ এ এম কাওসার হোসেন টগর বলেন, পরাজিত শক্তি সব সময় আমাদের শিল্প-সংস্কৃতি নিয়ে ষড়যন্ত্র করেছে এখনো করছে। তাদের মতের সঙ্গে না মিললেই তারা অপপ্রচার ও প্রোপাগান্ডা ছড়ায়। ফ্যাসিবাদমুক্ত নতুন বাংলাদেশে শিল্পীরা আগের চেয়ে এখন অনেক বেশি স্বাধীন। ফ্যাসিবাদের সব অপপ্রচার মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়ে ’৮৯-এর পরে এবার আমরা সবচেয়ে বড়, বর্ণিল ও সার্বজনীন শোভাযাত্রা করছি। সমতল ও পাহাড়ের মানুষের অংশগ্রহণ থাকবে এবারের শোভাযাত্রায়। এটি যেহেতু আবহমান বাংলার সার্বজনীন উৎসব তাই সব ধরনের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীকে আমরা রাখছি শোভাযাত্রায়। আমরা বুঝিয়ে দিব শিল্পীরা কোনো দলের না। তারা সব সময় সচেতন। বাংলাদেশের সংস্কৃতি তুলে ধরার প্রত্যয়ে আমরা লোকজ সংস্কৃতির ঐতিহ্য পালকি, জাতীয় মাছ ইলিশ, ঘোড়ার গাড়িসহ সব ধরনের সাংস্কৃতিক মোটিফ তুলে ধরা হবে এবারের র্যালিতে। এর আগে কখনো পটচিত্র ছিল না। এবার আমরা পটচিত্রও রেখেছি।
সব শ্রেণি-পেশার মানুষের সম্মিলন ঘটানোর উদ্যোগ
শোভাযাত্রা কর্মযজ্ঞের সঙ্গে সম্পৃক্ত গ্রাফিকস ডিজাইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও ঢাকা সহকারী প্রক্টর ইসরাফিল রতন বলেন, বৈশাখ হচ্ছে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমগ্র বাঙালি তথা বাংলাদেশিদের উৎসব। ফ্যাসিবাদের আমলে হীন রাজনীতির কারণে সব কিছু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী নতুন বাংলাদেশের এবারের শোভাযাত্রায় আমরা দেশের সব শ্রেণির মানুষের সম্মিলন ঘটানোর উদ্যোগ নিয়েছি। চারুকলা অনুষদের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, এলামনাইয়ের পাশাপাশি বাইরের শিল্পীদের অংশগ্রহণ ঘটিয়েছি। আমরা চাইছি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর এই উৎসব এখন আর শুধু চারুকলার নয়, সারা দেশের মানুষের। অতীতে মঙ্গল শোভাযাত্রাগুলো অনেক বেশি রাজনৈতিক ছিল। কিন্তু জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে পাওয়া নতুন বাংলাদেশে সব বৈষম্য দূর করে এটিকে সর্বস্তরের মানুষের শোভাযাত্রা করার চেষ্টা করছি। আমরা চাই সারা দেশের সব মানুষই হবে এই শোভাযাত্রার আয়োজক। একটি গোষ্ঠী শোভাযাত্রাকে বিগত বছরগুলোতে রাজনীতিকীকরণ করেছিল এবারও নোংরা রাজনীতি করতে চাইছে। তবে আমরা চাই সবাই বিশাল এ কর্মযজ্ঞে আমাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পথ চলুক।
আমরা শিল্পের পসরা সাজিয়ে বসেছি
শোভাযাত্রার পেইন্টিংয়ের কাজে দায়িত্বরত সোহাগ পারভেজ বলেন, এবারের শোভাযাত্রা বিগত বছরগুলোর চেয়ে অনেকটা ব্যতিক্রম। কারণ এই প্রথম শোভাযাত্রাটি সর্বজনীন হচ্ছে। এবার আমাদের সঙ্গে শিল্পী, শিল্পানুরাগী, শিল্প সমালোচক, বুদ্ধিজীবীসহ সব ধরনের মানুষ সম্পৃক্ত হয়েছে। একটি বৃহৎ আর্ট ক্যাম্পের মাধ্যমে আমরা শিল্পের পসরা সাজিয়ে বসেছি। আমাদের মূল উদ্দেশ্য শুধু ফান্ড কালেকশন না, নতুন প্রজন্মকে আমাদের কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা। নতুন প্রজন্মকে নতুন ও আধুনিক চিন্তার মধ্য দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে চাই। নতুন বাংলাদেশে আমরা এবারের শোভাযাত্রায় সব জাতিগোষ্ঠীকে সংযুক্ত করার লক্ষ্যে চাকমা, মগ, খাসিয়া, রাখাইন, সাঁওতাল, হাজং, মণিপুরিসহ সব জাতিগোষ্ঠীকে একই কাতারে রাখার টার্গেট নিয়ে কাজ করছি। কারণ বাংলাদেশ আমাদের সবার। দল মত নির্বিশেষে সার্বজনীন বৈশাখ উদযাপনের লক্ষ্যেই কাজ করছি।
অসুন্দরের বিপক্ষে সুন্দরের পক্ষে হাতিয়ার
এবারের শোভাযাত্রার অন্যতম অনুষঙ্গ মুখোশ নির্মাণের দায়িত্বে আছেন সাজান রানা। চারুকলা অনুষদের জয়নুল আর্ট গ্যালারিতে নিজের বাহিনী নিয়ে বিশাল কর্মযজ্ঞ নিয়ে ব্যস্ত তিনি। কথা প্রসঙ্গে জানান, বাঘ, হাতি, লক্ষ্মীপেচা, শান্তির প্রতীক পায়রাসহ বিভিন্ন ধরনের কাগজের মুখোশ নির্মাণ করছেন তিনি। সাজান রানা বলেন, ‘এবারের শোভাযাত্রাটি অসুন্দরের বিপক্ষে সুন্দরের পক্ষে হাতিয়ার। যার কারণে আমরা মুখোশের মাধ্যমে প্রতিবাদ জানানোর জন্য আমাদের শিল্পকর্ম সাজাচ্ছি। ২০ থেকে ২৫ রকমের মুখোশ নির্মাণে তারা ব্যস্ত সময় পার করলেও র্যালিতে বাঘ ও হাতিকেই উপস্থাপন করা হবে। আর অন্য মুখোশগুলো ফান্ড তৈরির জন্য বিক্রয় করা হচ্ছে। ইতোমধ্যেই ব্যাপক সাড়া পেয়েছেন বলেও জানালেন। ১৫০ টাকা থেকে ৫০০ টাকার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের মুখোশ বিক্রি করছেন বলেও জানান।