খসে পড়ছে নাটোরের উত্তরা গণভবনের স্থাপত্যশৈলীর কারুকার্য। এতে করে নষ্ট হচ্ছে উত্তরা গণভবন তথা দিঘাপতিয়া রাজবাড়ির সৌন্দর্য ও নান্দনিকতা। মোগল ও পাশ্চাত্যরীতির মিশ্রণে তৈরি ইতিহাস ঐতিহ্যবহন করা উত্তরা গণভবনের কারুকার্য রক্ষার জন্য ইতিমধ্যে বিশেষজ্ঞদের মতামত চেয়ে চিঠি দিয়েছে নাটোর গণপূর্ত বিভাগ।
জানা যায়, ১৭৩৪ সালে দিঘাপতিয়া রাজবাড়ি তথা উত্তরা গণভবন প্রাসাদের মূল অংশ ও কিছু ভবন নির্মাণ করেন রাজা দয়ারাম রায়। ১৮৯৭ সালের ১২ জুন এক ভূমিকম্পে রাজপ্রাসাদটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরবর্তীতে রাজা প্রমোদনাথ রায় দীর্ঘ ১১ বছর ধরে বিদেশি বিশেষজ্ঞ আর দেশি রাজমিস্ত্রিদের হায়তায় মোগল ও প্রাশ্চাত্যরীতির মিশ্রণে মোট ১২টি ভবন নির্মাণ করেন। আর তৎকালীন ওই যুগে এসব ভবন এবং কারুকার্যে ব্যবহার করা হয় চুন, সুরকি। তবে এসব স্থাপত্যশৈলীর স্থায়িত্ব নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে তা খসে পড়েছে। এতে করে নষ্ট হচ্ছে উত্তরা গণভবনের মূল প্যালেস, কুমার প্যালেস ও সংগ্রহশালা।
নাটোর জেলা প্রশাসন সূত্র জানা যায়, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নাটোরের দিঘাপতিয়া রাজবাড়ির নাম পরিবর্তন করে উত্তরা গণভবন ঘোষণা করেন। এরপর থেকেই জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে গণপূর্ত বিভাগ ভবনগুলোর দেখভাল করে আসছে। একাধিকবার মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকও হয় উত্তরা গণভবনে। বর্তমানে এটি দর্শনীয় স্থান হিসেবে পরিচালিত হয়ে আসছে।
গণপূর্ত বিভাগ জানায়, উত্তরা গণভবনের মূল কাঠামো ঠিক রেখে নান্দনিকতা ফেরাতে প্রতিবছর চুন আর রংয়ের কাজ করেন তারা। তবে এবার রং করতে গিয়ে কারুকার্য এবং নকশা খসে পড়ে দেখতে পান শ্রমিকরা। মূল প্যালেস, কুমার প্যালেস ও সংগ্রহশালা ভবনের প্রতিটি কারকার্য স্থায়ীত্ব নষ্ট হয়ে খসে খসে পড়ছে। এতে করে নষ্ট হচ্ছে ভবনগুলোর মূল কাঠামগুলো।
উত্তরা গণভবনের দায়িত্বে থাকা সহকারী ব্যবস্থাপক খায়রুল বাশার বলেন, যথাযথ সংস্কারের অভাবে ঐতিহাসিক উত্তরা গণভবনের প্রাচীন ভবনগুলো নষ্ট হয়ে যচ্ছে। ভবনের বেশির ভাগ জায়গায় কারুকার্যগুলো খসে পড়ছে। শ্রমিকরা রং করতে গিয়ে হাত দিলে তা ঝরে পড়ছে। কোন ভাবেই নকশাগুলো রক্ষা করা যাচ্ছে না। অতিদ্রুত ভবন সংস্কারের পাশাপাশি নকশাগুলো রক্ষা করা প্রয়োজন।
নাটোর গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী জাহিদুল ইসলাম বলেন, উত্তরা গণভবনের স্থাপত্যশৈলীর কারুকাজ ও নকশাগুলো অক্ষুন্ন রেখে কীভাবে সংস্কার কাজ করা যায়, তার জন্য গৃহহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালরে স্থাপত্য বিভাগে চিঠি পাঠানো হয়েছে। স্থাপত্য বিভাগের বিশেষজ্ঞরা সরেজমিনে পরিদর্শন করবেন। এরপর বাকি সংস্কার কাজ করবো।
তিনি আরও বলেন, উত্তরা গণভবনের ভবনগুলোর স্থায়ীত্ব নষ্ট হয়ে গেছে। দীর্ঘ দিনের ভবনগুলো হওয়ার কারণে কারুকার্যগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। যার কারণে স্থাপত্যশৈলীগুলো ভেঙে ভেঙে পড়ছে। এই স্থাপত্যগুলো রক্ষা করা খুবই জরুরি। আমরা স্থাপত্য বিভাগের বিশেষজ্ঞদের অপেক্ষায় রয়েছি। তারা পরিদর্শনের পরই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মতামত নিয়ে সংস্কার করা হবে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃৎশিল্প ও ভাস্কর্য বিভাগের শিক্ষক ড. একেএম আরিফুল ইসলাম বলেন, প্রাচীন স্থাপত্য একটা জাতির ইতিহাস ও ঐতিহ্যবহন করে। আর উত্তরা গণভবন নাটোরবাসীর এক গর্বের জায়গা। এ ইতিহাস এবং স্থাপত্যশৈলী নষ্ট হলে গণভবনের সৌন্দর্যহানির পাশাপাশি নাটোর হারাবে তার ইতিহাস-ঐতিহ্য। এজন্য চারুকলা ভাষায় উত্তরা গণভবনের স্থাপত্যশৈলীর সব নকশা বা কারুকার্যের ছবি তুলে হুবহু ফরমা তৈরি করে সংরক্ষণ করা যেতে পারে। এছাড়া মোল্ট বানিয়ে এসব কারুকার্য সংরক্ষণ করা যেতে পারে।
তিনি আরও বলেন, প্রয়োজন হলে স্থাপত্য বিষয়ে অভিজ্ঞদের পরিদর্শনের পর প্রাপ্ত পরামর্শের ভিত্তিতে গণভবনের স্থাপত্যশৈলীগুলো রক্ষা করতে হবে। একবার কারুকার্যগুলো ধ্বংস হয়ে গেলে, সেগুলো রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে। তাই বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে কারুকার্যগুলো রক্ষা করা প্রয়োজন।
বিডি প্রতিদিন/ফারজানা