শনিবার রাত সাড়ে ১০টা। বুকের বায়ু-থলি নিংড়ে বেরিয়ে গেল নিঃশ্বাস। মিলিয়ে গেল বাতাসে। হয়তো ছড়িয়ে গেছে আকাশেও। বাতাস তুমি যদি জানতে, বায়ু-থলি নিংড়ানো নিঃশ্বাসটুকু কার... আকাশ তুমি যদি জানতে, তোমার বুকে বাতাস কী ছড়িয়ে দিয়েছে...। ওই নিঃশ্বাসের সঙ্গে বেরিয়ে গেছে বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের দীর্ঘশ্বাসও। এ দীর্ঘশ্বাস প্রাণের শিল্পীর জন্য, এ দীর্ঘশ্বাস সুরের সাগরের জন্য, এ দীর্ঘশ্বাস একজন বশির আহমেদের জন্য। হে ক্যান্সার, তুমি এত নিষ্ঠুর কেন! তুমি কেবলই মানুষ চেনো, শিল্পী চেনো না।
৭৫ বছর। নিতান্তই একটি মৌলিক সংখ্যা। মানুষের জন্য হয়তো দীর্ঘকাল, কিন্তু সৃষ্টিশীলের জন্য স্বল্পকাল। তাই মাত্র ৭৫ বছরেই সৃষ্টিশীলের জীবনের গল্পের শেষে ইতিচিহ্ন বসে গেল। কিন্তু তিনি বুনে গেলেন নতুন গল্পের বীজ। ছেলে রাজা বশির আর মেয়ে হোমায়েরা বশিরের হাতে তুলে দিলেন সেতার, তবলা, বেহালা...। স্ত্রী মিনা বশির স্বামীর শোক ভুলবেন সোনালি কণ্ঠের পুরনো রেকর্ডে।
বশির আহমেদ কোনো কালের নন। তিনি কালজয়ী। সেদিনের নবীনের কণ্ঠেও তার গান বেজে ওঠে। তাইতো একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার তার কাজের স্বীকৃতি নয়, পথচলার অনুপ্রেরণা মাত্র।
বশির আহমেদের বাবা ছিলেন নাসির আহমেদ, আর মা মোমেনা খাতুন। তাদের ঘর আলো করে ১৯৩৯ সালের ১৮ নভেম্বর পৃথিবীতে আসেন এই ক্ষণজন্মা শিল্পী। কলকাতা শহরে তার জন্ম। ছোটবেলায় মা যখন তাকে ঘুমপাড়ানির গান শোনাতেন, কান খাড়া হয়ে যেত ছোট্ট বশিরের। ঘুমপাড়ানির গান ছাড়া সে ঘুমাতে পারত না। আরেকটু বড় হয়ে মায়ের সঙ্গে তিনিও গুনগুনিয়ে ঘুমপাড়ানির গান গাইতেন। এভাবেই গানের সঙ্গে বশির আহমেদের সম্পর্ক। দিন দিন তিনি বড় হতে থাকেন, গানের সঙ্গে সম্পর্ক আরও গাঢ় হতে থাকে। পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি গাইতেন নিয়মিত। বাবা কিংবা মা কেউই তাতে বাধা দিতেন না, দিতেন অনুপ্রেরণা। তাইতো ওস্তাদ ধরিয়ে দিলেন। ওস্তাদ বেলায়েত হোসেন বাঁকার কাছেই তার গানের হাতেখড়ি। তার অধীনেই দীর্ঘদিনের সংগীতচর্চা। এরপর ওস্তাদ গোলাম আলী খাঁর কাছে অনেক দিন তারশি নিয়েছিলেন। চর্চা করে গেছেন দিনের পর দিন। মনে বড় শিল্পী হওয়ার ইচ্ছা। দিন দিন ইচ্ছা প্রবল হতে থাকে, বড় হতে থাকে স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন নিয়েই ছবিতে গান গাওয়ার জন্য পাড়ি জমান বোম্বেতে। অপরিচিত জায়গায় এসে দিশাহারা হয়ে যান বশির আহমেদ। কিন্তু স্বপ্ন হারাননি, স্বপ্ন নিয়েই সংগ্রাম করে গেছেন। হঠাৎ এক সকাল তার জন্য 'নতুন ভোর' নিয়ে এলো। পেয়ে গেলেন এক বন্ধুর দেখা। সেই বন্ধু বশির আহমেদকে নিয়ে গেলেন গীতিকার রাজা মেহেদী আলী খানের কাছে। তখন বশির আহমেদ ১৮ পেরিয়েছেন মাত্র। কিন্তু কণ্ঠে প্রবল জাদু। সেই জাদুতে মুগ্ধ হন রাজা মেহেদী। তিনি মুগ্ধ হয়ে তাকে নিয়ে যান সংগীত পরিচালক মোহাম্মদ শফির কাছে। তিনিও বশির আহমেদের কণ্ঠের জাদুতে মুগ্ধ। শুরু হয় শিল্পী বশির আহমেদের সংগীতে পথচলা। রাজা মেহেদী আলী খানের কথায় এবং মোহাম্মদ শফির সুর-সংগীতে বশির আহমেদ প্লেব্যাক করেন মুম্বাইয়ের 'আবুল হাসান' চলচ্চিত্রে। এরপর 'জিন্দেগী'সহ আরও বেশ কয়েকটি ছবিতে পরপর প্লেব্যাক করে ফেলেন। কিন্তু বয়স আর কত! তাই মা-বাবার টানে মুম্বাই থেকে কলকাতা ফিরে আসেন। কিন্তু সংগীতচর্চা? এলো নতুন মোড়।
গুলিস্তান সিনেমা হলের মালিকের আমন্ত্রণে ঢাকাসহ কয়েকটি জেলায় গান শোনাতে এলেন বশির আহমেদ। গান গাইলেন। কিন্তু তিনি কি জানতেন, অতিথি হয়ে এসেই এ দেশে থেকে যাবেন? ভাগ্যের লিখন যায় না বোঝা। বেড়াতে এসে বশির আহমেদ ঢাকার ছবির গানে প্লেব্যাকের প্রস্তাব পান। নির্মাতা এহতেশাম এবং মোস্তাফিজুর রহমান ধরলেন- প্লেব্যাক করতে হবে। গাইলেন মোস্তাফিজুর রহমানের 'তালাশ' এবং এহতেশামের 'রাজধানীর বুকে' চলচ্চিত্রে। এভাবেই ঢাকার ছবিতে তার প্লেব্যাক শুরু। এরপর বশির আহমেদ নায়ক রহমানের প্রথম পরিচালিত ছবি 'দর্শন'র সংগীত পরিচালনার দায়িত্ব পান। এ ছবির ৯টি গানই সুুপারহিট হয়। এ ছবিতে রহমানের বিপরীতে ছিলেন শবনম। নায়ক রহমানের সঙ্গে তার খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। যে কারণে রহমান কী চাইতেন তা বুঝতেন। এরপর কাজী জহিরসহ আরও অনেকের ছবির জন্য গান গেয়েছেন তিনি। তবে 'যারে যাবি যদি যা' কিংবা 'আমাকে পোড়াতে যদি এত লাগে ভালো' রেডিওতে গেয়ে আরও জনপ্রিয়তা পান তিনি। রেডিওতে জনপ্রিয় হওয়ার পর সেসব গান ছবিতে সংযুক্ত করা হয়েছে গল্পের ধারাবাহিকতা অনুযায়ী। পাকিস্তানের জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী নূরজাহানের মতো শিল্পীর সঙ্গেও বশির আহমেদ গান গেয়েছেন। তার সঙ্গে গাওয়া 'তুমজো মিলে পেয়ার মিলা' কিংবা 'চুনলিয়া এক ফুলকো' গান ব্যাপক হিট হয়। এসবই এখন ইতিহাস। কিন্তু ধুলো জমবে না কখনো। ইতিহাসের বুক চিরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা বিখ্যাতদের অতীতে ধুলো জমে না। তা কেবলই সোনালি অতীত।
গতকাল সকালে বশির আহমেদের দেহ মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় কবরস্থানে রেখে আসতে হয়েছে। কিন্তু তার বর্ণাঢ্য ইতিহাস আমরা সঙ্গে নিয়ে চলছি। বয়ে চলবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। কনকচাঁপা, শাকিলা জাফরের মতো শিল্পীদের তো তিনিই নিজের হাতে গড়েছেন। আর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য রেখে গেছেন- 'সজনী গো ভালোবেসে এত জ্বালা কেন বলো না', 'আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল', 'প্রেমের এক নাম জীবন', 'ডেকো না আমারে তুমি কাছে ডেকো না', 'অনেক সাধের ময়না আমার', 'খুঁজে খুঁজে জনম গেল', 'আমি সাত সাগর পাড়ি দিয়ে', 'অথৈ জলে ডুবে যদি মানিক পাওয়া যায়'... আরও কত-শত গান।