রাজনীতি এবং চলচ্চিত্র- এই দুই অঙ্গনের একটিতেও সঠিক মূল্যায়ন পাননি অভিনেতা ফারুক। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে ছাত্র অবস্থায়ই ১৯৬৬ সালে ছয় দফা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন তিনি। এ কারণে তার নামে ৩৭টি মামলা দায়ের করা হয়। মামলা থেকে বাঁচতে বন্ধুদের পরামর্শে চলচ্চিত্রে আসেন ফারুক। ১৯৭১ সালে এইচ আকবর পরিচালিত 'জলছবি'র মাধ্যমে বড় পর্দায় নায়ক হিসেবে যাত্রা শুরু তার। আওয়ামী লীগের সক্রিয় কর্মী হিসেবে প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন এবং এখনো আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত আছেন তিনি। কিন্তু দলটি আজও কোনো মূল্যায়ন করেনি তাকে। এমনকি বিভিন্ন সময় চলচ্চিত্রকারদের দাবি সত্ত্বেও এফডিসির এমডি পদে নিয়োগ দেয়নি তাকে সরকার। অথচ এই পদে অনেক জ্ঞান-গরিমাহীন অযোগ্য লোক বসিয়ে উন্নয়নের বদলে প্রতিষ্ঠানটিকে পঙ্গু করা হয়েছে।
ফারুক বলেন, জোর দিয়ে বলতে পারি মুক্তিযুদ্ধে যে ৩০ লাখ বাঙালি জীবন দিয়েছে তার মধ্যে ৯৯ ভাগই সাধারণ মানুষ। কিন্তু তাদের ভাগ্যে যেখানে বীরউত্তম বা বীরবিক্রম এর মতো কোনো উপাধি জোটেনি সেখানে আমার মতো সাধারণ মানুষের মূল্যায়ন আশা করা অবান্তর। তারপরও বলব, মূল্যায়ন চাইব না কেন? দেশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছি, তারপরও কেন অবহেলিত থাকব।
ফারুক বলেন, ১৯৭৫ সালে জাতীয় পুরস্কার প্রবর্তনের প্রথমবারই নারায়ণ ঘোষ মিতার 'লাঠিয়াল' চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেতার পুরস্কার পাই। কিন্তু পরবর্তী সময়ে অনেক সফল চলচ্চিত্রে কাজ করে সর্বস্তরের প্রশংসা পেলেও শুধু রাজনৈতিক কারণে আমাকে আর কখনো জাতীয় পুরস্কার দেওয়া হয়নি। ফারুক একাধারে অভিনেতা, প্রযোজক, প্রদর্শক। নব্বই দশকে চলচ্চিত্র শিল্প দৈন্যদশায় পড়লে লোকসানের ভারে ঘোড়াশালে তার মালিকানাধীন 'জলসা' সিনেমা হলটি বন্ধ হয়ে যায়। তিনি নিজেও চলচ্চিত্র থেকে দূরে সরে যান।
ফারুক বলেন, গত ২২ বছরে অনিচ্ছা সত্ত্বেও আবদার রাখতে গিয়ে ৩-৪টি ছবিতে অভিনয় করতে হয়েছে। ৭০-৮০'র দশকের মতো ভালো পাণ্ডুুলিপি ও নির্মাতার অভাবে চলচ্চিত্র এখন মৌলিকত্ব হারিয়েছে। অনেকের অভিযোগ, পাইরেসি এবং স্যাটেলাইট চ্যানেলের কারণে চলচ্চিত্র ব্যবসায় ধস নেমেছে। এটি বাজে কথা। আশির দশকে প্রতিটি বাড়িতে ভিসিআরে ভারতীয় ছবি চলত। কিন্তু ওই সময় তো আমাদের ছবি দর্শকবিমুখ হয়নি। বরং ভারতীয় ছবির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তখনকার ছবি ব্যবসাসফল হতো। ষাটের দশকে ভারতীয় ও পাকিস্তানি ছবির সঙ্গে টেক্কা দিয়ে আমাদের বাংলা ছবি দর্শকনন্দিত হয়েছে। তাই আগে নিজেদের অদক্ষতার বিষয়টি নজরে আনতে হবে। চলচ্চিত্রের বর্তমান দুরবস্থার জন্য সরকারকে দায়ী করার কোনো যুক্তি নেই। কারণ সরকার অনুদান দিচ্ছে, আর্কাইভ ও ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেছে, চলচ্চিত্রকে শিল্প ঘোষণা করেছে, প্রেক্ষাগৃহের কর মওকুফ করেছে, এফডিসির আধুনিকায়নে অর্থ বরাদ্দ দিয়েছে। এখন ফিল্ম সিটির উন্নয়নে সরকারকে সঠিক প্রস্তাবনা দেওয়া দরকার। সরকারের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে সম্মিলিতভাবে সংশ্লিষ্টদের এই শিল্পের উন্নয়ন করতে হবে। ফারুক বলেন, এখন ৩ এপ্রিল এলে আনন্দিত হই। দিনটিকে চলচ্চিত্র দিবস হিসেবে ঘোষণার জন্য ৩৩ বছর আগে আমিই প্রথম দাবি জানিয়েছিলাম। তবে চলচ্চিত্র সংগঠনগুলোর এই শিল্পের উন্নয়নে ভূমিকা স্থবির হয়ে পড়াকে দুঃখজনক বলেন তিনি। তার কথায় 'প্রতিটি সংগঠন আমার হাতে গড়া। ডিস্ট্রিবিউটর অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচিত চেয়ারম্যানও ছিলাম। কিন্তু চলচ্চিত্রের বর্তমান চিত্র দেখে লজ্জিত ও ব্যথিত হই। চলচ্চিত্রের মিয়াভাই-খ্যাত ফারুক খান পাঠান এখন স্ত্রী ফারহানা পাঠান, কন্যা ফারিয়া তাবাসসুম পাঠান এবং পুত্র রওশন হোসেন পাঠানকে নিয়ে উত্তরার বাসায় সুখে-দুঃখে দিন কাটাচ্ছেন। কালিয়াকৈরের টেক্সটাইল মিলটি জীবিকা নির্বাহের প্রধান উৎস তার। বর্তমানে এ দেশে টেক্সটাইল শিল্পের দুরবস্থা নিয়ে সরকারের ওপর ক্ষোভ রয়েছে ফারুকের। তার কথায়, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান উৎস দুটি। একটি হচ্ছে ম্যানপাওয়ার অন্যটি টেক্সটাইল শিল্প। অথচ গার্মেন্ট খাতকে সুযোগ-সুবিধা দিলেও টেক্সটাইলকে অবহেলিত করে রেখেছে সরকার। ফারুক বলেন, দেশ বাঁচাতে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছি। এখন প্রয়োজনে চলচ্চিত্র শিল্প রক্ষায় আরেকটি যুদ্ধে নামব।