দেখতে দেখতে তিনটি বছর পার হয়ে গেল। ২০১২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ফাগুনের আগুনে বিষাদের কালো আঁভা ছড়িয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছিলেন অভিনয়ের কিংবদন্তী পুরুষ হুমায়ুন ফরিদী। কাঁদিয়েছিলেন কোটি ভক্তকে।
চরিত্র থেকে চরিত্রে ভিন্নতা নিয়ে এই মানুষটি হয়ে উঠেছিলেন ভার্সেটাইল। অভিনয়ের সাবললীতায় মঞ্চ থেকে ছোট কিংবা বড় পর্দায় কোটি মানুষকে মোহিত করেছেন এই অভিনেতা। অভিনয় দিয়ে মানুষকে কাঁদিয়েছেন, হাসিয়েছেন আবার ক্রোধে জ্বালিয়েছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন অভিনেতা কমই এসেছে যে কিনা একই সাথে মঞ্চ, টিভি এবং চলচ্চিত্রে দাপটের সঙ্গে অভিনয় করেছেন।
বরেণ্য অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদি ১৯৫২ সালের ২৯ মে ঢাকার নারিন্দায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম এটিএম নূরুল ইসলাম ও মা বেগম ফরিদা ইসলাম। চার ভাই-বোনের মধ্যে তার অবস্থান দ্বিতীয়। ইউনাইটেড ইসলামিয়া গভর্নমেন্ট হাই স্কুলের ছাত্র ছিলেন তিনি। মাধ্যমিক স্তর উত্তীর্ণের পর চাঁদপুর সরকারী কলেজে পড়াশোনা করেন। এরপর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
থাকতেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আল-বেরুনী হলে। সেখানেই সান্নিধ্য পান নাট্যচার্য সেলিম আল দীনের। তার হাত ধরেই জড়িয়ে পড়েন গ্রুপ থিয়েটারের সঙ্গে। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তঃবিভাগ নাট্য উৎসবে অংশগ্রহণ করলেও মূলত ঢাকা থিয়েটারের নাট্যচর্চার মধ্য দিয়েই নিয়মিত নাট্যচর্চার সঙ্গে যুক্ত হন তিনি।
এরপর শহিদুল্লাহ কায়সারের উপন্যাস অবলম্বনে আবদুল্লাহ আল মামুন নির্মিত ‘সংশপ্তক’ ধারাবাহিকে কানকাটা রমজান চরিত্রে অভিনয় করে দারুণ প্রশংসিত হন। শুরু হয় ছোটপর্দায় হুমায়ুন ফরিদীর অভিনয় আধিপত্য। এরপর দীর্ঘ সময় তিনি ছোটপর্দায় সাফল্যের সঙ্গে অভিনয় করেছেন। ২০১২ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত টিভি নাটকে অভিনয় করেছেন। হুমায়ুন ফরিদী চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করেন ১৯৯০-এর দশকে। অভিনয়ে নিয়ে আসেন ব্যক্তি কারিশমা। স্ক্রিপ্টের বাইরেও নিজে থেকে ডায়লগ তৈরি করে বলে ফেলতেন অনেকসময়। জনপ্রিয়তার শীর্ষে আরোহন করেন।
হুমায়ুন ফরিদী অভিনীত উল্লেখযোগ্য মঞ্চনাটকের মধ্যে রয়েছে কিত্তনখোলা, মুন্তাসির ফ্যান্টাসি, কেরামত মঙ্গল, ধূর্ত উই প্রভৃতি। উল্লেখযোগ্য টিভি নাটকের মধ্যে রয়েছে নিখোঁজ সংবাদ, হঠাৎ একদিন, পাথর সময়, সংশপ্তক, সমুদ্রে গাংচিল, কাছের মানুষ, মোহনা, নীল নকশাল সন্ধানে, দূরবীন দিয়ে দেখুন, ভাঙনের শব্দ শুনি, কোথাও কেউ নেই, সাত আসমানের সিঁড়ি, সেতু কাহিনী, ভবের হাট , শৃঙ্খল, জহুরা, আবহাওয়ার পূর্বাভাস, প্রতিধ্বনি, গুপ্তধন, সেই চোখ, অক্টোপাস, বকুলপুর কত দূর, মানিক চোর, আমাদের নুরুল হুদা প্রভৃতি।
হুমায়ুন ফরিদী এফডিসি ঘরানার বাণিজ্যিকধারার চলচ্চিত্রে যেমন অভিনয় করেছেন, তেমনি বিকল্পধারার চলচ্চিত্রেও রেখেছেন কৃতিত্বের সাক্ষর।
হুমায়ুন ফরিদী উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে সন্ত্রাস, দহন, লড়াকু, দিনমজুর, বীর পুরুষ, বিশ্ব প্রেমিক, আজকের হিটলার, দুর্জয়, শাসন, আঞ্জুমান, আনন্দ অশ্রু, মায়ের অধিকার, আসামী বধূ, একাত্তরের যীশু, প্রাণের চেয়ে প্রিয়, ভালোবাসি তোমাকে, কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি, প্রবেশ নিষেধ, ভণ্ড, অধিকার চাই, মিথ্যার মৃত্যু, বিদ্রোহী চারিদিকে, মনে পড়ে তোমাকে, ব্যাচেলর, জয়যাত্রা, শ্যামল ছায়া, দূরত্ব, কি যাদু করিলা, মেহেরজান প্রভৃতি।
ব্যক্তিগত জীবনে হুমায়ুন ফরিদী দুবার বিয়ে করেন। প্রথম বিয়ে করেন ১৯৮০’র দশকে। ‘দেবযানী’ নামের তার এক মেয়ে রয়েছে এ সংসারে। পরবর্তীতে অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফাকে বিয়ে করলেও তাদের বিচ্ছেদ ঘটে ২০০৮ সালে।
নাট্যাঙ্গনে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠানের ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে তাকে সম্মাননা প্রদান করে। ২০০৪ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন।
বিডি-প্রতিদিন/১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৫/ এস আহমেদ