দুর্নীতি, অনানুষ্ঠানিক খাতের আধিক্য, অর্থায়নের সীমিত সুযোগ ও উচ্চ করহার ছাড়াও বাংলাদেশে বিনিয়োগের বড় বাধা হচ্ছে বিদ্যুতের সমস্যা। এর মধ্যে আবার নতুন শিল্পের গ্যাসের দাম বাড়ানোয় অনিশ্চয়তার পাশাপাশি প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা হারানোর ঝুঁকি তৈরি হয়েছে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে। ভোক্তা ও ব্যবসায়ীদের তীব্র আপত্তির পরও নতুন শিল্পের গ্যাসের দাম প্রতি ইউনিটে ১০ টাকা বা ৩৩ শতাংশ বৃদ্ধি করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। ফলে ক্যাপটিভ (বিদ্যুৎ উৎপাদনে) যেটা বর্তমানে ৩১.৫০ টাকা, এটি হবে ৪২ টাকা। শিল্প খাতে বর্তমানে যেটা রয়েছে ৩০ টাকা, এটি হবে ৪০ টাকা। নতুন শিল্পের পাশাপাশি এখন যারা অনুমোদিত লোডের বেশি গ্যাস ব্যবহার করছেন, সেসব শিল্পপ্রতিষ্ঠানকেও ৩০ টাকার পরিবর্তে ৪০ টাকা দরে বিল দিতে হবে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, ব্যবসাবাণিজ্যের ওপর গ্যাসের দাম বাড়ানোর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। নতুন বিনিয়োগেও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। নতুন ও পুরাতন বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অসম প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হবে। সরকারের এই সিদ্ধান্তে মনে হচ্ছে দেশে আর নতুন কোনো শিল্প গড়ে না উঠুক নতুন করে বিনিয়োগ না আসুক।
এ বিষয়ে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি রিজওয়ান রাহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শিল্পের গ্যাসের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হলো, এখন আমাদের পণ্যের খরচ বাড়বে না কমবে? মূল্যবৃদ্ধি কি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য সহনীয় পর্যায়ে দাঁড়াবে, কি দাঁড়াবে না। এই প্রশ্ন কিন্তু ব্যবসায়ী সমাজের কাছে থেকে যাবে। এটা কিন্তু কোনোভাবেই আমাদের ক্রয় ক্ষমতা, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য সুফল বয়ে আনবে না। এ বিষয়ে আমরা সবাই এখন আতঙ্কিত।
রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ব্যবসার পরিবেশে অনিশ্চয়তা আর ব্যাংক ঋণে উচ্চ সুদহারের প্রভাবে গত কয়েক মাস বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি কমছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা। বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘উইকলি সিলেক্টেড ইকোনমিক ইন্ডিকেটরস’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণের পরিমাণ আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৬ দশমিক ৮২ শতাংশ বেড়েছে। আগের মাস জানুয়ারিতে ছিল ৭ দশমিক ১৫ শতাংশ। গত বছরের ডিসেম্বরে ছিল ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ। নভেম্বরে ৭ দশমিক ৬৬, অক্টোবরে ৮ দশমিক ৩০, সেপ্টেম্বরে ৯ দশমিক ২০, আগস্টে ৯ দশমিক ৮৬, জুলাইয়ে ১০ দশমিক ১৩ এবং জুনে ৯ দশমিক ৮৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। বিদেশি বিনিয়োগও কমছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে। ছয় মাসে কমেছে ৭১ শতাংশের বেশি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, চলতি অর্থবছরের (২০২৪-২৫) প্রথম ছয় মাসে বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে ২১ কোটি ৩০ লাখ ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৭৪ কোটি ৪০ লাখ ডলার।
সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের বেসরকারি খাতবিষয়ক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এখনো অর্থায়নের সীমিত সুযোগ, দুর্নীতি, অনানুষ্ঠানিক খাতের আধিক্য, উচ্চ করহার ও বিদ্যুতের সমস্যা রয়েছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, আগের চেয়ে বিনিয়োগ এখন অনেক বেশি কঠিন হয়ে গেছে। একদিকে বেড়েছে ডলারের দাম, অন্যদিকে ব্যাংক সুদহারও চড়া। এ অবস্থায় নতুন বিনিয়োগ করতে গেলে আগের চেয়ে অনেক বেশি অর্থ লাগে। আবার উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে বাজারে পণ্যের চাহিদাও কমে গেছে। নতুন করে গ্যাসের দাম বাড়ানোয় বিনিয়োগে অনিয়শ্চয়তা তৈরি হবে বলে আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা।
এদিকে বিনিয়োগ সম্মেলন পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন জানান, চীনা প্রতিষ্ঠান হান্ডা ও দেশীয় কোম্পানি শপআপ ৩ হাজার ১০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ ঘোষণা করেছে।
ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি রিজওয়ান রাহমান আরও বলেন, সরকার বিনিয়োগ সম্মেলন করার পরদিন গ্যাসের দাম বাড়ানোর মানে কি বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে মশকরা? বিনিয়োগের আহ্বান জানাবেন আবার গ্যাসের দাম বাড়াবেন। এটা কীভাবে সম্ভব। বিনিয়োগকারীদের বললেন এক রকম, করলেন আরেক রকম। তাহলে কীভাবে হবে।
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী (পারভেজ) বলেন, গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী। দীর্ঘ দিন ধরে দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে। সুদহার বৃদ্ধিসহ নানা কারণে দিনদিন ব্যবসায়ীদের অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। এসব সমস্যার মধ্যেই সরকার শিল্পের গ্যাসের দাম ৩৩ শতাংশ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটা আমাদের জন্য আত্মঘাতী। সরকারের এই সিদ্ধান্তে মনে হচ্ছে দেশে আর নতুন কোনো শিল্প গড়ে না উঠুক, নতুন করে বিনিয়োগ না আসুক।
এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, দেশে অস্থির পরিস্থিতি বিরাজ করছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। সংঘাত-নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে সবার মধ্যে ভয়-আতঙ্ক বিরাজ করছে। এমন পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীরা ঠিকমতো ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারছেন না। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অনুসরণ করছে। এর অংশ হিসেবে নীতি সুদহার বাড়ানো হচ্ছে। এর ফলে ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়ছে। সব মিলিয়ে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে।
জ্বালানির দর পুনর্বিবেচনার আহ্বান ফিকির : গ্যাসের নতুন মূল্যহারকে বৈষম্যমূলক আখ্যায়িত করে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সংগঠন ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ফিকি)। বলেছে নতুন গ্রাহক, প্রতিশ্রুত গ্রাহক ও বিদ্যমান গ্রাহকদের জন্য আলাদা আলাদা গ্যাসের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। সরকারের টেকসই ও নির্ভরযোগ্য জ্বালানি সরবরাহের যে লক্ষ্য রয়েছে তাতে পূর্ণ সমর্থন জানালেও বিইআরসি ঘোষিত প্রাকৃতিক গ্যাসের মূল্যহারের ফলে নতুন বিনিয়োগ ও শিল্প সম্প্রসারণ চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হবে বলে জানিয়েছে সংগঠনটি।
ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি জাভেদ আখতার বলেন, ‘শিল্পের প্রবৃদ্ধি ও বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জনে একটি স্বচ্ছ ও সামঞ্জস্যপূর্ণ জ্বালানিমূল্য নির্ধারণকাঠামো আবশ্যক। আমরা জ্বালানির চাহিদা ও তা সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার বিষয়টি বিবেচনায় রেখে বিইআরসিকে নতুন এই গ্যাসের মূল্যকাঠামো পুনর্বিবেচনা করার আহ্বান জানাচ্ছি এবং দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের মতো বৃহৎ লক্ষ্যগুলোকে প্রাধান্য দিয়ে নীতি নির্ধারণে দাবি জানাই।’
সংগঠনটি আশা করে বিইআরসি এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করে একটি প্রতিযোগিতামূলক ও দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগে সহায়ক জ্বালানিমূল্য ঘোষণা করবে।