যত দিন যাচ্ছে দেশের রাজনীতি ততবেশি ঘোলাটে হচ্ছে। ফ্যাসিস্টদের বিচার, সংস্কার, নির্বাচন নিয়ে দেশবাসীর উচ্চাশা থাকলেও পরিস্থিতি মোড় নিচ্ছে অন্যদিকে। সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে ঐক্য করার উদ্যোগের মধ্যে শুরু হয়েছে দোষারোপের রাজনীতি। সেই সঙ্গে বাড়ছে পারস্পরিক অবিশ্বাস। দৃশ্যমান খেলোয়াড়দের সঙ্গে নেপথ্যের খেলোয়াড়দের তৎপরতা বাড়ছে। এ অবস্থায় দেশবাসী বুঝতে পারছে না রাজনীতির অঙ্গনে আসলে হচ্ছেটা কী?
রাজনীতিতে এখন সবচেয়ে বেশি আলোচিত ইস্যু সংস্কার আর নির্বাচন। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানিয়ে আসছে বিএনপি। এই নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচনের কোনো নির্দিষ্ট দিন তারিখ ঘোষণা করা হয়নি। গত বুধবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপি বৈঠক করলেও সেখানে নির্বাচন নিয়ে কোনো রোডম্যাপ না পাওয়ায় অসন্তোষ রয়েছে দলটির মধ্যে। এই নিয়ে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে রয়েছে মতপার্থক্য। একেক দল একেক সময় নির্বাচনের দাবি করছে। কেউ সংস্কার ছাড়া নির্বাচনে যেতে রাজি নয়, আবার কেউ নির্বাচনে যেতে হলে দাবি পূরণ করে যেতে হবে- এমন দাবি তুলছে। রাজনৈতিক দলগুলোর এমন মতপার্থক্য সবকিছুতে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের আট মাস পেরিয়ে গেলেও নির্বাচন ঠিক কবে হতে পারে- এ নিয়ে এখনো সুনির্দিষ্ট কোনো ঘোষণা পাওয়া যায়নি। এ নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে যে সময়সীমার কথা বলা হচ্ছে তাতে নির্বাচন নিয়ে জনমনে একধরনের ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়ে গত বুধবার ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন বিএনপি প্রতিনিধিরা। কিন্তু এই আলোচনা একেবারেই সদার্থক হয়নি। বৈঠক শেষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, আমরা একেবারেই সন্তুষ্ট নই। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এরই মধ্যে কয়েকবার বলেছেন, দলগুলো বড় ধরনের সংস্কার চাইলে নির্বাচন আগামী বছরের জুনে আর ছোট আকারের সংস্কার চাইলে সেক্ষেত্রে ডিসেম্বরে নির্বাচন হতে পারে। তবে ডিসেম্বরের পরে নির্বাচন আয়োজনে বিরোধী বিএনপি। চলতি বছরের জুন থেকে ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন চায় তারা। বিএনপির এই দাবির পক্ষে রয়েছে আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দল। আর জামায়াতের দাবি ছিল, সংস্কার শেষে যৌক্তিক সময়ে নির্বাচন। গতকাল মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, আগামী রমজানের আগে নির্বাচন হলে ভালো হবে।
জামায়াতে ইসলামী নেতারা জানান, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ খাতে প্রয়োজনীয় সংস্কার করে নির্বাচনে যেতে হবে। এর মধ্যে থাকতে হবে দৃশ্যমান, গ্রহণযোগ্য, মৌলিক সংস্কার। সংস্কার না করে যে নির্বাচন হবে, সেই নির্বাচন গণতন্ত্রের জন্য কোনো ভিত্তি রচনা করতে পারবে না। বরং অতীতের যেসব নির্বাচন দেশ ও জাতির কাছে মোটেই গ্রহণযোগ্য হয়নি, সে রকম হয়তো আরেকটা খারাপ নির্বাচন হবে। তবে আগামী রমজানের আগে নির্বাচন হলে পরিবেশ ভালো থাকবে বলে মনে করেন নেতারা।
এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে অবশেষে জামায়াতে ইসলামীর দাবি কিছুটা হলেও পরিবর্তিত হয়েছে। তবে এখন নির্বাচন ইস্যুতে বিএনপির অবস্থানের কাছাকাছি পর্যায়ে চলে এসেছে দলটি। অন্যদিকে, জুলাই আন্দোলনকে ঘিরে গড়ে ওঠা নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) কয়েকটি রাজনৈতিক দলের দাবি, আগে সংস্কার ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন এবং সবশেষে জাতীয় নির্বাচন। আবার গণপরিষদ নির্বাচনের দাবিও তুলছে এনসিপি। দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, মৌলিক সংস্কার ছাড়া এনসিপি নির্বাচনে যাবে না। পাশাপাশি অন্তর্বর্তী সরকারকে পাঁচ বছর ক্ষমতায় রাখার কথাও শোনা যাচ্ছে। এ নিয়ে রাজনীতির মাঠে চলছে নানা আলোচনা। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মতপার্থক্য থাকতে পারে। তাই বলে আজ এক কথা কাল আরেক কথা- এটা ঠিক নয়। নির্বাচন নিয়ে সবাই এক ছাতার নিচে আসা উচিত। সংস্কার ও ফ্যাসিস্টদের বিচার প্রক্রিয়া কেমন হবে- সেজন্য দলগুলো আলোচনায় আসতে হবে। আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত সংস্কার কার্যক্রম করা সম্ভব। আর বিচারিক কার্যক্রম একটা লম্বা প্রক্রিয়া। তাও আলোচনার মাধ্যমে কোন প্রক্রিয়ায় বিচার হবে তাও বের করা সম্ভব। আর নির্বাচন বিলম্বিত হলে ফ্যাসিস্টদের উত্থান হতে পারে। সেজন্য যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন হলে দেশের জন্য মঙ্গল হবে বলে মনে করেন তারা। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক নূরুল আমিন ব্যাপারী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো ও সরকারের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে একটা দূরত্ব রয়েছে। এর মধ্যে বিএনপি চায় ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন, আর ড. মুহাম্মদ ইউনূস ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলছেন। সাধারণত মে ও জুন মাসে নির্বাচন হয় না। কারণ ওই সময় দেশের আবহাওয়া ভালো থাকে না। আর জামায়াত আগামী রমজানের আগে নির্বাচন চায়। তার মানে ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচন চায় দলটি। সুতরাং দুই থেকে চার মাসের ব্যবধান। এটা নিয়ে রাজনীতির মাঠে কোনো ঘোলাটে পরিস্থিতি দেখছি না। সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো আলোচনার টেবিলে বসলে এ সবের সমাধান হয়ে যাবে। তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো চাইলে ডিসেম্বরের মধ্যে সংস্কার করা সম্ভব। নির্বাচন ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলো ধীরে ধীরে কাছাকাছি আসারই কথা। কারণ সব রাজনৈতিক দলের লক্ষ্য হলো ক্ষমতায় যাওয়া। আর ক্ষমতায় যাওয়ার নিয়মতান্ত্রিক পথ হলো নির্বাচন। তিনি আরও বলেন, জামায়াতের আমিরের বক্তব্যের পেছনে অবশ্যই লন্ডনের প্রভাব আছে। বিএনপি চেষ্টা করছে গণতন্ত্রকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য যাতে রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধ করা যায়। বিএনপির এই নির্বাচনের দাবিকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। তবে আমি যতটুকু বুঝতে পারছি, বিএনপি দ্রুত প্রয়োজনীয় সংস্কার সেরে নির্বাচন চায়।