আমাদের অবস্থা হলো নামাজের থিউরিটিক্যাল তালিম তথা মাসআলার জ্ঞান অর্জন করি কিন্তু প্র্যাকটিক্যালি তালিম নিই না। ফলে অবস্থা এই হয়েছে যে, নামাজ পড়ছে সবাই মহব্বতের সঙ্গে; কিন্তু নামাজের শুরুতে তাকবিরে তাহরিমা বলার সময় দশজন দশভাবে হাত উঠাচ্ছে। রুকু করছে; তো যে যেভাবে ইচ্ছা রুকু করছে, যেভাবে ইচ্ছা সেজদা করছে, মোনাজাত করছে। মনে হচ্ছে যেন কোনো নিয়ম-কানুন নেই। নামাজের যে বৈশিষ্ট্য ছিল সেটা আর অবশিষ্ট থাকছে না।
আমাদের নামাজ দেখে অন্যান্য জাতি পেরেশান হয়ে যায় যে, তাদের এ নামাজ তারা কতভাবে আদায় করছে। এর কারণ কী? কারণ হলো, ইলম না থাকা। হজরত হাসান বসরির (রহ.) উক্তি আমাদের এতক্ষণের আলোচনার মূল কথা- কোনো বিষয়ের প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হলো-আমলের আগে ইলম থাকতে হবে। এ জন্য হজরত হাসান বসরি (রহ.) বলেন, ‘৪০ বছর ইবাদতের চেয়ে এক মুহূর্ত জ্ঞান অর্জন করা অনেক বেশি জরুরি এবং অনেক বেশি দামি।’ কারণ ৪০ বছরের আমল ইলম ছাড়া করলে তা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। অথচ সহিহভাবে দুই রাকাত নামাজ পড়তে পারলেও আল্লাহপাক এ দুই রাকাতের উসিলায় নাজাতের ব্যবস্থা করে দিতে পারেন। আর যদি সহিহভাবে না পড়া হয় তাহলে ৪০ রাকাত পড়লেই বা কী হবে।
রসুলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবুওয়াত পেলেন ৪০ বছর বয়সে। ৪০ বছর বয়সে যখন তাঁর নবুওয়াতের সূচনা হচ্ছিল, তখন তা কীভাবে হয়েছিল? তাঁকে কি বলা হয়েছিল যে, দুই রাকাত নামাজ পড়? কিংবা বলা হয়েছিল যে, কিছু দান-খয়রাত কর কিংবা রোজা রাখ? এসবের কোনোটাই বলা হয়নি। বলা হয়েছিল, দীনের শিক্ষা অর্জন কর! যে দ্বীনের নবী বানিয়ে তোমাকে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছি, হজরত আদম (আ.) এর মাধ্যমে যে দীনের সূচনা করেছিলাম, যে দীন এতদিন অসম্পূর্ণ ছিল, সে দীন আমি তোমার মাধ্যমে পরিপূর্ণতায় পৌঁছাতে চাই। সেই দীনকে বোঝার এবং অপরকে বোঝানোর জন্য তোমাকে আমি নবুওয়াত প্রদান করছি, যার সূচনা হচ্ছে ইলমের মাধ্যমে। প্রথমে ইলম তারপর আমল।
সুতরাং বোঝা গেল যে, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়াতের প্রারম্ভ দ্বীনি ইলমের মাধ্যমে হয়েছে। ইসলামের শত্রুদের গভীর চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে বিশ্বের মুসলমানদের হেফাজতের জন্য, দীনের হেফাজতের জন্য দীনি ইলমের শিক্ষা একান্ত প্রয়োজন। পৃথিবীর সব জাতির ক্ষেত্রে এটা চরম সত্য যে, যে জাতি তাদের শিক্ষাকে আঁকড়ে ধরে থেকেছে, তারা তাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও তাহজিব-তামাদ্দুন নিয়ে মাথা উঁচু করে টিকে থাকতে সক্ষম হয়েছে। আর যে জাতি তাদের শিক্ষার ব্যাপারে অবহেলা দেখিয়েছে, তারা পৃথিবীতে অর্থের দিক দিয়ে উন্নতি সাধন করতে পারলেও নিজের ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টি-কালচার নিয়ে বেঁচে থাকতে পারেনি। একদিন না একদিন তারা ধ্বংসের অতলান্তে তলিয়ে গেছে। সুতরাং বর্তমান সময়ে মুসলমানদের জন্য সহি সমঝ অর্জন খুবই জরুরি।
হজরত হাজি ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী (রহ.)-কে একজন প্রশ্ন করেছিল যে, আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেছেন, ‘আমি মানুষ এবং জিন জাতিকে সৃষ্টি করেছি একমাত্র আমার ইবাদতের জন্য।’ সুতরাং মানুষ যদি শুধু ইবাদতই করে, তাহলে তারা বাঁচবে কী করে? হাজি সাহেব (রহ.) বললেন, মিয়া তুমি ইবাদতের অর্থই বোঝনি। ইবাদতের অর্থ হলো, তুমি এ পৃথিবীতে যা কিছু করবে, একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করবে। যেমন তুমি ব্যবসা করতে বের হয়েছ। তোমার উদ্দেশ্য হবে, হে আল্লাহ! তুমি আমাকে সৃষ্টি করেছ পানাহারের চাহিদা দিয়ে, সুতরাং আমার নিজের পরিবার-পরিজন এবং আত্মীয়-স্বজনের চাহিদা মেটানোর জন্য আমি ব্যবসা করতে যাচ্ছি। তোমার দেওয়া বুদ্ধি-বিদ্যা বলে আমি যা আয় করব, তা থেকে আমি কিছু অংশ গরিব-মিসকিনকে দেব, কিছু অংশ মসজিদ-মাদরাসায় দেব, কিছু অংশ আত্মীয়-স্বজনকে দেব, কিছু অংশ ভবিষ্যৎ সঞ্চয়ের জন্য রেখে দেব, আর বাকি অংশ দিয়ে আমার পরিবার-পরিজন যাদের দায়িত্ব তুমি আমার ওপর অর্পণ করেছ তাদের চাহিদা মেটাব। এতে পুরো ব্যবসা-বাণিজ্য বা উপার্জনের কাজটা ইবাদতে পরিণত হয়ে যাবে।
সুতরাং ইবাদতের অর্থ বুঝতে হবে। নতুবা বিভ্রান্তির শিকার হওয়ার সম্ভাবনা। মসজিদে ঢুকছি আর আমি বলছি আল্লাহুমাফ তাহলি আবওয়াবা রাহমাতিকা তাহলে আমার দশটা নেকি হচ্ছে। এটা তো সহজ, কিন্তু এটা কি কখনো ভেবে দেখেছি যে, প্রস্রাবখানায় ঢোকার সময়ও যদি দোয়া পড়ি তাহলেও আল্লাহতায়ালা এর বদৌলতে দশটা নেকি দান করবেন। সুতরাং ইবাদত হলো নিজের কাজগুলো আল্লাহর হুকুম ও রসুলের তরিকা অনুযায়ী আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য করা। এটার জন্য আলাদাভাবে ফিকির করার প্রয়োজন নেই, বরং নিজের নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজগুলোর মধ্যে চেষ্টা করলে এবং নিয়ত করলে এ ফল পাওয়া যাবে। চেষ্টা করার পর ব্যর্থ হলেও আল্লাহপাক সওয়াব দান করবেন। তাই সর্বপ্রথম ইলমের প্রয়োজন।
চিন্তা করে দেখুন! আমরা যারা বয়স্ক হয়ে গেছি, আমাদের মা-বাবারা আমাদের দীন-ধর্মের কথা কিছু শিক্ষা দিয়েছিলেন, নিজেরা কিছু করে শুনিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে আমাদের যে প্রজন্ম আসছে, তাদের জন্য আমরা কী করছি? তাদের মাঝে যদি দীনি ইলম না আসে, আমল না আসে, তাহলে এর জন্য তারাই শুধু দায়ী হবে না, আমরা মুরব্বিরাও দায়ী হব। তাই আমার ইহকাল ও পরকালের কামিয়াবির জন্য নিজের পরিবার-পরিজনের মধ্যে দীনি এলেমের চর্চা, আমলের চর্চা অব্যাহত রাখতে হবে।
লেখক : আমির, আল হাইআতুল উলয়া ও বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ
বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ