ঘণ্টা বা দিন নয়। মাস বা বছরও নয়। অপেক্ষায় কেটে গেছে বছরের পর বছর। পছন্দের মানুষের দেখা মিলবে এমনটাই বিশ্বাস। সকাল থেকে সন্ধ্যা। সূর্যাস্ত আইন মেনেই অপেক্ষা। অপেক্ষার তালিকায় বাদ যায়নি ছুটির দিনও। এককেন্দ্রিক ভালবাসায় কাতর এমন এক যুবকের দেখা মিলে ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের রোকেয়া হলের গেটে। পটুয়াখালীর গলাচিপার মামুনের বিশ্বাস তিনি যাকে ভালবাসতেন একদিন না একদিন তার দেখা মিলবেই।
পুরো নাম মামুনুর রশিদ। ৪ বছর ধরে অপেক্ষায় আছেন প্রিয়তমার। ২০০৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে মাস্টার্স মামুন একই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ইংরেজি বিভাগের এক শিক্ষার্থীর প্রেমে পড়েন। ফেসবুকে দেখা এমন একটি খবর প্রকাশ হলে প্রতিবেদকের অনুসন্ধানে ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায়। রোকেয়া হলে কর্মরত অনেকের সঙ্গে কথা বলেও জানা যায় মামুনুর রশিদের অপেক্ষার কথা। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত ৯ টা পর্যন্ত তিনি সেখানে দাঁড়িয়ে থাকেন। অপেক্ষা ভালবাসার মানুষটির জন্য। একটু সময়ের জন্য কোথাও যান না যদি তার ভালবাসার মানুষটি চলে যায়। ২৭তম বিসিএস দিয়েছিলেন। পরে আর কোন কাজ করেননি। অনেক চাকরির সুযোগ পেলেও তিনি যোগ দেননি। মামুন জানান, ২০০৭ সালে তার পরিচয় হয় ইংরেজি বিভাগের অনিমার (ছদ্মনাম) সঙ্গে। মার্চ মাসে ডিপার্টমেন্টে দেখেন তাকে। তখন তাকে দেখলেই মামুনের কথা বলতে ইচ্ছা হতো, কি যেন মনে হতো। যেন সে তার কত আপন। তাকে নিয়ে সারাক্ষণ ভাবতো। তখন তিনি বুঝতে পারলেন মেয়েটিকে তিনি ভালবাসেন। সেই ধারণা থেকেই তিনি অনিমাকে তার ভালবাসার কথা জানালেন। কিন্তু অনিমা তাকে মোটেও ভালবাসতো না। পাত্তা দিতো না। তিনি সেই সময় থেকেই একতরফা ভালবেসে যান।
মেয়েটিকে একটু দেখার জন্য তার ক্লাসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতেন, মেয়েটি রোকেয়া হলে থাকতো তাই তিনি হলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতেন। কিন্তু কোন সাড়া পেতেন না। তবে তার ধারণা মেয়েটি তাকে ভালবাসে এবং আজীবন ভালবেসে যাবে। এই ধারণা থেকে তিনি আজও অনিমার অপেক্ষা দাঁড়িয়ে থাকেন রোকেয়া হলের সামনে। তবে মেয়েটি এখন আর রোকেয়া হলে থাকে না। তার বিয়ে হয়ে গেছে। চলে গেছে স্বামীর বাড়িতে। কিন্তু এই কথাটি এখন মামুন বিশ্বাস করতে চান না। বাবা-মায়ের সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই। তার পিতা ইসমাইল মিয়া গলাচিপার একটি বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক। ৫ ভাই বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। বিডিআর ১ নম্বর গেটে একটি মেসে থাকেন তিনি। কেউ তাকে বোঝাতে পারে না যে, অনিমা এখানে নেই। কেউ তাকে বোঝাতে এলে মামুন বলে উঠেন, আপনারা মিথ্যা বলছেন। এখান থেকে আমার চলে যাওয়ার জন্যই বলছেন। আমি জানি অনিমা আমার সঙ্গে দেখা করতে আসবেই। রোকেয়া হলেন গার্ড গিয়াসউদ্দিন বলেন, প্রায় তিন বছর ধরে সে এখানে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু যে আপার জন্য আসে সে এখান থেকে অনেক আগেই চলে গেছে। তাকে আমরা অনেকভাবে বুঝিয়েছি যে, মেয়েটি এখানে নেই কিন্তু তিনি তা বুঝতে চান না। প্রতিদিন হোস্টেলের গেট খোলার সঙ্গে সঙ্গে এখানে এসে দাঁড়িয়ে থাকেন এবং গেট বন্ধ হলে চলে যান। আর বলেন, আমি জানি অনিমা আসবেই।
রোকেয়া হলের আবাসিক শিক্ষক জানান, অনিমা এই হলের ৫৯ নম্বর রুমে ছিল কিন্তু এখন আর সে এখানে নেই। তার বিয়ে হয়ে গেছে তাই সে চলে গেছে। আমরাও দেখেছি মামুন নামের একটি লোক এভাবে প্রতিদিন গেটে দাঁড়িয়ে তাকে আমরা প্রশাসনকে জানিয়েছি কয়েকবার। তাকে অনেকবার পুলিশের হাতেও তুলে দেয়া হয়েছে। কিন্তু ছাড়া পেয়ে এসে আবার এখানেই দাঁড়িয়ে থাকেন। প্রেম পাগল মামুন একসময় সত্যিকার অর্থে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। পাগল হয়ে সব কিছু ভুলে গেলেও, মামুন ভোলেনি রোকেয়া হল আর অনিমাকে। আজও তিনি অপেক্ষা করেন তার ভালবাসার মানুষকে পাওয়ার জন্য। দাঁড়িয়ে থাকে। রোকেয়া হলের সামনে। প্রতিটি বিশেষ দিনে অনিমার জন্য লাল গোলাপ ও উপহার হাতে নিয়ে অপেক্ষা করেন। তার বিশ্বাস অনিমা তার উপহার নিতে আসবে। তার মুখে বার বার একটি কথা উচ্চারিত হতে শোনা যায়, ‘সে আসবে। তাকে তো আসতেই হবে। সে আমার ভালবাসা। হয়তো বা পড়ছে, তাই আসতে একটু দেরি হচ্ছে। এই তো এখনি চলে আসবে।’ এমন কিছু কথা বলে বেড়ান তিনি। মামুন বলেন, আমার সঙ্গে একটু রাগারাগি হয়েছিল অনিমার। অভিমানে কাতর অনিমা তাই আমার সঙ্গে দেখা করে না। কিন্তু রাগ কমলে সে আসবে। আমি যখন গেট থেকে একটু দূরে যাই তখন অনিমা হল থেকে বাইরে আসে। আমার সঙ্গে তার শেষ দেখা হয়েছিল গত বছরের পহেলা বৈশাখে। তখন আমি কথা বলতে পারিনি। আমার কিছু চাওয়ার নেই। শুধু দেখা হওয়ার অপেক্ষায়। তাই এখানে দাঁড়িয়ে থাকা। আমাকে সবাই পাগল বলে। কাউকে ভালবাসা যদি পাগলামি হয় তাহলে আমি তাই। যে যাই বলুক আমি এখান থেকে যাবো না। আমি দূরে থাকলে যেমন অনিমার কষ্ট হয় তেমনি আমারও কষ্ট হয় তাই আমি এখানে এসে দাঁড়িয়ে থাকি। কথাগুলো বলতে বলতে বারবার মোবাইল ফোনে কাউকে কল করছিলেন। জানতে চাইলে বলেন অনিমাকে কল করছেন। যেটা তিনি ৩ বছর ধরে করছেন কিন্তু নম্বরটি বন্ধ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হল এলাকায় নিয়মিত যাতায়াত করেন এমন অনেকেই দেখেছেন শ্মশ্রুমণ্ডিত মামুনুর রশিদকে।
সূত্র: মানবজমিন