চুলের সৌন্দর্য ধরে রাখতে হলে অতিরিক্ত চা, কফি খাওয়া চলবে না। চুল ঝরা আমাদের প্রায় প্রত্যেক মেয়ের বড় সমস্যা। চুল ঝরা রুখতে নিয়মিত প্রতিদিন পানি, তরল পর্যাপ্ত পরিমাণে খেতে হবে। প্রতিদিন ৬ থেকে ৮ গ্লাস পানি খাওয়া দরকার। এছাড়া আরও কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য নিচে দেওয়া হল-
অ্যানিমিয়া অর্থাৎ রক্তাল্পতা অর্থাৎ রক্তে হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়াতেই চুল ঝরে বেশি। আর ওজন বেশি হওয়া সত্ত্বেও আপনি অ্যানিমিক হতে পারেন। আবার প্রোটিনের ঘাটতির কারণেও চুল ঝরে। প্রোটিনে থাকা ২২ অ্যামাইনো অ্যাসিডের মধ্যে চুলের পুষ্টির জন্য দরকার মাত্র ৪টি অ্যামাইনো অ্যাসিড।
যে প্রোটিন মাংসপেশি ভাল গড়ে, আপনি হয়ত সেইসব প্রোটিনই বেশি খাচ্ছেন। চুলের ভালর জন্য জরুরি যে সব অ্যামাইনো অ্যাসিড, সেইসব তাতে নেই। আপনি অ্যানিমিক কিনা তা জানতে হবে রক্তের মধ্যে থাকা ফেরিটিন–এর মাত্রা পরীক্ষার মাধ্যমে। অ্যানিমিক হলে আয়রন সাপ্লিমেন্ট নিতে হবে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে। আয়রন বেশি আছে এমন সব প্রাকৃতিক খাবারদাবার খেতে হবে। যে সব খাবার থেকে সিস্টিন, লিউসিন, মেথিওনিন এবং আইসোলিউসিন এই ৪ অ্যামাইনো অ্যাসিড অবশ্যই মিলে যায়, সেইসব খাবারদাবার বেশি খেয়ে যেতে হবে।
যেমন: বিট, গাজর, শালগম, বেগুন, শসা, ঢ়্যাঁড়শ, আমন্ড, টম্যাটো, ফুলকপি, সব ধরনের কপি, কপির ডাটাপাতা, আপেল, কলা, খেজুর, ডুমুর, আঙুর, কাজুবাদাম, কুমড়ো, কাঁচকলা, পিচফল, স্ট্রবেরি, ডিম, মাংস, দুধ, দই, মাখন, খমির, হোলমিল্ক পাউডার, সজনে শাক, পালং, শালগমের শাক, লালশাক, ডাঁটাশাক, ডাল, চাল, আটা।
স্ক্যাল্পের ওপর ব্লটিং পেপারের টুকরো ১৫ সেকেন্ড চেপে ধরে থাকুন। যদি ব্লটিং পেপার ভিজে ওঠে, তাহলে বুঝবেন আপনার স্ক্যাল্প তৈলাক্ত। এই পরীক্ষা চালানোর দু’দিন আগে থেকে মাথা ধোবেন না। ব্লটিং পেপার না ভিজলে বুঝতে হবে স্ক্যাল্পের ত্বক স্বাভাবিক। ব্লটিং পেপারে যদি মরা চামড়া, খুশকি উঠে আসে, তাহলে বুঝবেন, স্ক্যাল্প ত্বক ড্রাই অথবা শুকনো।
কিছু কিছু মানুষের চুল ঝরে কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণের ওষুধ খেলে। আলসারের ওষুধ, পারকিনসনের ওষুধ খাওয়ার জেরে কারও কারও চুল ঝরে। অ্যান্টিকোয়াগুলান্ট, অ্যান্টিথায়োরেড এজেন্ট, বাতব্যথা নিবারণী ওষুধ, আর্থ্রাইটিসের ওষুধ, খিঁচুনি দমনের ওষুধ, অবসাদরোধী ওষুধ খেয়ে যাওয়ার কারণেও চুল ঝরে। কারও কারও ভিটামিন 'এ' জাতীয় ওষুধ খাওয়ার কারণেও চুল ঝরে। কেমোথেরাপি চললে, বিটা ব্লকার এবং ক্যালশিয়াম চ্যানেল ব্লকারের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াতেও ঝরে চুল। কিছু কিছু গর্ভনিরোধক পিলে অ্যানড্রোজেনের মাত্রা কম থাকে, তাই সেইসব পিল খাওয়ার কারণেও ঝরে যেতে থাকে চুল। তবে কেশবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অ্যানিমিয়ার কারণেই বেশি ঝরে চুল।
তেলা স্ক্যাল্প হলে ডিপ ক্লিনজিং এফেক্ট আছে এমন শ্যাম্পু ব্যবহার করে যেতে হবে প্রতিদিন। স্ক্যাল্প শুকনো হলে ময়েশ্চারাইজিং এফেক্ট রয়েছে এমন শ্যাম্পু ব্যবহার করতে হবে একদিন পরপর। হেভি–বেসের কন্ডিশনার ব্যবহার করতে হবে। পার্মিং, স্ট্রেটেনিং, আয়রনিং— এসব বছরে একবার করলেই যথেষ্ট। তবে হেয়ার কালারিং করা যেতেই পারে। পার্মিং, ব্লিচিং নিজেরা না করে হেয়ার স্টাইলিস্টকে দিয়ে করানো উচিত।
তেলা স্ক্যাল্প ক্ষেত্রে তেল অথবা কন্ডিশনার, এরকম কোন কিছুই ব্যবহার করবেন না। স্ক্যাল্প শুকনো যাদের এরকম ক্ষেত্রে জোজোবা অয়েল বা নারকেল তেল মালিশ করুন সপ্তাহে একদিন বা দু’দিন।
কর্মরত মহিলাদের জন্য ছোট চুলই ভাল। মাসে একবার ট্রিমিং করিয়ে নেবেন। মাথা মালিশ করিয়ে রক্তসঞ্চালন বাড়ানো যায় এরকম ধারণা একদম ঠিক নয়। তাই মাথা মাসাজ করানো ছাড়ুন। স্ক্যাল্প যেরকমই হোক, হট অয়েল ট্রিটমেন্ট নয়। হট অয়েল ট্রিটমেন্ট করলে স্ক্যাল্পের আর্দ্রতা হ্রাস পায়। এখন পর্যন্ত যেটুকু জানা গেছে, স্ক্যাল্পে স্রেফ রোজমেরি অয়েল মালিশের জেরেই চুলের গোড়ায় রক্তপ্রবাহ বাড়ে।
শরীরের আয়রন খামতি পূরণে আয়রন ট্যাবলেট খেতে হবে। আর লেবু এবং মেটে। লেবুতে থাকা ভিটামিন সি আয়রন শরীরের আত্মীয়করণে সাহায্য করে। মেটে খেতে বলা এই কারণে, যেহেতু উদ্ভিজ্জ আয়রন মলের সঙ্গে বেরিয়ে যায়।
প্রোটিন (কেরাটিন) খামতির কারণে যেমন চুল পড়ে, তেমনই জিঙ্কের ঘাটতি হলে চুলের রঙ হালকা হয়ে যায়। চুল ঝরে। একজিমা পর্যন্ত হয়। অত্যাবশ্যকীয় ফ্যাটি অ্যাসিডের অভাব ঘটলেও এরকম হয়। মুসুর ডাল, ছোলার ডাল, বরবটি, রাজমা, অড়হর ডাল, মুগ ডাল, আলু, বাজরা, ভুট্টা, চাল, গম, রাগি, সবুজ শাকপাতা, জোয়ার, ধনে, সর্ষে, মেথি, শুকনো লঙ্কা, সয়াবিন, নারকেলে ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে।
শীতকালে চুল পড়া আটকানোর সোজা রাস্তা:
আধ কাপ কমলালেবুর রস, এক টেবিল চামচ মধু একসঙ্গে মিশিয়ে সারা মাথা জুড়ে চুলের গোড়ায় মাসাজ করতে হবে। এরপর মিশ্রণ যেটুকু বাঁচবে সমস্ত চুলে মাখিয়ে নিন। ৩০ মিনিট বাদে অ্যান্টি ড্যানড্রাফ শ্যাম্পু করে নিন। সপ্তাহে অন্তত দু’দিন করুন। এতে খুশকি দূর হবে, চুল পড়া বন্ধ হবে, চুল সিল্কি হবে। হেয়ার বাউন্স হবে দুরন্ত।
ইউনিভার্সিটি অফ ব্রিস্টলের ডাঃ ইয়ান স্টিফেন এবং তার সহযোগীরা পরামর্শ দিয়েছেন, ত্বককে সজীব করে জেল্লা আনতে নিয়মিত শাকসবজির স্যুপ খান। আর দু’বেলা খান কলা, কমলা, আপেল, পেয়ারা, কামরাঙা, টম্যাটো, পাকা পেঁপে, বৈঁচি, কুয়াশ, স্ট্রবেরি এরকম ফল যখন যে–বেলা যেরকম পাবেন।
চুলের সুস্বাস্থ্যের জন্য ভিটামিন বি কমপ্লেক্স চাই। এতে চুলের স্বাস্থ্য ভাল হয়। চুল উজ্জ্বল হয়, চুল পড়া আটকানোও যায়। যে সমস্ত ফল, সবজি কাঁচা খাওয়া যায়, সেগুলি কাঁচাই খান। তাজা খান। টম্যাটো, ভাপেসেদ্ধ বাঁধাকপি, ফুলকপি, লেটুস পাতা, শসা, গাজর, বিট এসবের স্যালাড খান অনেকটা করে। ভিটামিন পাবেন, এনজাইম মিলবে এবং কিছু খনিজ পদার্থও পেয়ে যাবেন। চুলের সুস্বাস্থ্যের জন্য আয়রন, জিঙ্ক, ম্যাগনেসিয়াম, সালফার, পটাসিয়াম, ফসফরাস, আয়োডিন এসব খনিজ পদার্থও দরকার। শরীরে আয়রনের খামতি হলে চুল লাবণ্য হারায়, ভেঙে যায়। ঝরে যেতে থাকে। তাই আয়রনের ঘাটতি পুষিয়ে ফেলতে হবে।
সালফার দরকার বি ভিটামিনকে আত্মস্থ করার জন্য। বি ভিটামিন চুলকে শক্তপোক্ত করে। সালফার স্ক্যাল্পে ব্যাকটিরিয়া এবং ছত্রাকঘটিত সংক্রমণ রোখে। সর্ষের তেলে গন্ধক থাকে। নারকেল তেল যারা ব্যবহার করেন, তারা ওই তেলের সঙ্গে এক চিমটি কর্পূর মিশিয়ে নিন, সংক্রমণ রোধ হবে। উকুন মরবে।
আয়োডিনের ঘাটতিতেও চুলের নানা সমস্যা হয়। যে সমস্ত খাবার খেয়ে থাকেন বা খাচ্ছেন, সে সব থেকে পর্যাপ্ত খনিজ এবং ভিটামিন পাচ্ছে কিনা শরীর তা আপনাকেই যাচাই করতে হবে। প্রতিদিন সবুজ শাকসবজি খেতে হবে। অন্তত একবার আটার রুটি বা ছাতু খান।
টকদই চুলের স্বাস্থ্যের জন্য জরুরি। প্রতিদিন খেতে পারেন। যতটা ইচ্ছে করে, ততটাই খেয়ে যান। বেশি কফি বা চা খাবেন না। বেশি কফি, বেশি অ্যালকোহল, সিগারেট ইত্যাদিতে অভ্যস্ত হয়ে গেলে শরীর ভিটামিন আত্মস্থ করতে পারে না। প্রতিদিন এক গ্লাস করে ভেজিটেবল জুস যদি খেতে পারেন, তাহলে শুধু চুলেরই নয়, সারা শরীরেরই উপকার হবে।
চুল আঁচড়াবার সময় নরম ব্রাশ ব্যবহার করুন। চিরুনি, ব্রাশ সপ্তাহে একদিন করে ডেটল বা স্যাভলন ব্যবহার করে ধুয়ে নিন।
বিডি প্রতিদিন/২৫ ডিসেম্বর ২০১৬/হিমেল