'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি' গানের স্রষ্টা, বরেণ্য ভাষাসংগ্রামী ও পথিকৃৎ সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরীকে আজীবন সম্মাননা জানালো বাংলাদেশ প্রতিদিন। আজ শনিবার বেলা সোয়া ১১টায় রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় বাংলাদেশ প্রতিদিন কার্যালয়ে গাফফার চৌধুরীর হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে এ সম্মাননা ক্রেস্ট তুলে দেন বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান।
সাংবাদিকতা, বাংলা সাহিত্য ও বাংলা ভাষায় তার বিশাল অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ প্রতিদিন এই প্রথিতযশা ব্যক্তিত্বকে আজীবন সম্মাননা জানালো।
সম্মাননার ব্যাপারে অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে আবদুল গাফফার চৌধুরী বলেন, আমি গর্বিত, আনন্দিত। এখানে এসে সাংবাদিকতা পেশার যে উন্নয়ন দেখলাম তা সত্যিই বিষ্ময়কর। সাংবাদিকতা করে টাকা পাওয়া যায় তা আজ দেখছি, যেটা আমাদের সময় চিন্তাই করা যেত না। আমরা যখন সাংবাদিকতা করেছি, এ পেশার খুবই খারাপ অবস্থা ছিল। তখন ছিল রাজনৈতিক পত্রিকা। পত্রিকা বের করতো বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের লোকজন। পত্রিকাগুলো তাদের দলের মুখপাত্র হয়ে কাজ করতো। এই দলতন্ত্রের কবল থেকে সাংবাদিকতাকে মুক্তি দিয়েছে বসুন্ধরা গ্রুপ। একটা ছাদের নিচে এতগুলো মিডিয়া, টিভি, রেডিও, অনলাইন, দৈনিক সংবাদপত্র- এত বড় ব্যবস্থাপনা একমাত্র টাইমস পাবলিকেশনস ছাড়া আর কোথাও দেখিনি। আমার স্নেহভাজন ভাই নঈম নিজাম যে কাগজটা সম্পাদনা করছে, এই বাংলাদেশ প্রতিদিনের ব্যাপারে আমি গর্বিত যে, কাগজটি বাংলাদেশে আজ সর্বাধিক পঠিত। ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে। মনোপলির সুযোগ নিয়ে কিছু পত্রিকা দেশের যে ক্ষতি করেছে সেটা ভাঙতে পেরেছে বাংলাদেশ প্রতিদিন।
অনুষ্ঠানের শুরুতে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক নঈম নিজাম। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান। আরও উপস্থিত ছিলেন দৈনিক কালের কণ্ঠ'র সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন, ডেইলি সান'র ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক আমির হোসেনসহ ইস্ট-ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের সাংবাদিক, কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ।
আবদুল গাফফার চৌধুরীকে ফুল দিয়ে বরণ করে নেন বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান। পরে তাকে উত্তরীয় পরিয়ে দেন বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান ও বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম। এরপরই তাকে সম্মাননা ক্রেস্ট তুলে দেওয়া হয়।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে আহমেদ আকবর সোবহান বলেন, গাফফার চৌধুরী এমন একজন সাংবাদিক যার কলম কোনদিন কাউকে ভয় পায়নি। নির্ভয়ে, নিঃশব্দে তিনি লিখে গেছেন দেশের পক্ষে, দেশের মানুষের পক্ষে। স্বাধীনতার পক্ষে, স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তির পক্ষে। যখন যে সরকারই আসুক, তার কলম কোনদিনই থামেনি। তার সম্পর্কে বললে সারাদিন বলতে হবে। বাংলাদেশ প্রতিদিন আজ তাকে সম্মাননা জানাচ্ছে। সম্মাননা শুধু মুখে মুখে না থেকে আমরা চাই উনার শ্রেষ্ঠ লেখাগুলো দিয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিন একটা বই ছাপাবে। উনাকে সম্মাননা জানানোর মতো দুঃসাহস আমাদের নেই। তবুও বাংলাদেশ প্রতিদিন সাহস করে তাকে সম্মাননা জানাচ্ছে। এ দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছ থেকে তার সম্মাননা পাওয়া উচিত। আমি তার দীর্ঘায়ু কামনা করি, দোয়া করি স্বাধীনতার পক্ষে তিনি যেন জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লিখে যেতে পারেন।
গাফফার চৌধুরী বলেন, আমি সারাজীবন সাংবাদিকতা করেছি। ইচ্ছা ছিল সাহিত্যিক হব। কিন্তু হতে পারিনি। তখন আমাদের প্রকাশনা শিল্প ছিল অনেক দরিদ্র। তখন যদি বসুন্ধরা চেয়ারম্যানের মতো একজন প্রকাশক থাকতো, তাহলে হয়তো আমি সাংবাদিক না হয়ে সাহিত্যিক হতাম। আমরা যখন সাংবাদিকতা শুরু করি তখন এ পেশায় তেমন টাকা পাওয়া যেত না। ছোট্ট একটা ঘরে বসে পত্রিকা বের করতাম। বেতন নিতে অনেক কষ্ট করতো হতো। সাংবাদিক শুনলে কেউ মেয়ে বিয়ে দিতে চাইতো না। বেতনও আসতো ভেঙে ভেঙে। আজকে ৫টাকা, কালকে ১০ টাকা। সেই অবস্থা থেকে আজকের এই যে বসুন্ধরার পত্রিকা অফিসে বসে আছি, মনে হচ্ছে নিউইয়র্ক টাইমস অফিসে বসে আছি। এই যে উন্নয়ন দেখে গেলাম, বলতে দ্বিধা নেই, টাইমস অফিসও বোধহয় এতটা গোছালো না। সাংবাদিকতা করে যে টাকা পাওয়া যায় সেটা আজ দেখছি।
আবদুল গাফফার চৌধুরীর মাধ্যমে বাংলা ভাষা সারা পৃথিবীতে নতুন করে জাগ্রত হয়েছে উল্লেখ করে বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক নঈম নিজাম বলেন, বাংলা ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে মানুষকে সংগঠিত করায় গাফফার চৌধুরীর অবদান অবিস্মরণীয়। তাকে সম্মাননা জানাতে পেরে আমরা গর্বিত, আনন্দিত। মিডিয়া জগতে বসুন্ধরা গ্রুপের প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, বাংলাদেশে মিডিয়া জগতে এত বড় বিনিয়োগ আর কারও নেই। একইসঙ্গে টিভি, রেডিও, অনলাইন পোর্টাল, দু'টি বাংলা দৈনিক, একটি ইংরেজি দৈনিকে কয়েক হাজার মানুষ কাজ করছে। এখানকার সংবাদকর্মীরা সব ধরণের স্বাধীনতা পেয়ে থাকে। সততা ও ন্যায়ের পথে থেকে সাধারণ মানুষের কথা বলে বাংলাদেশ প্রতিদিন আজ দেশের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক। শহর থেকে জেলা, উপজেলা, থানা- সর্বত্র পাওয়া যায় পত্রিকাটি। তিনি জানান, বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের জন্য বরেণ্য মানুষদের বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্মাননা জানিয়ে আসছে। এর আগে ভাষাসংগ্রামী আবদুল মতিন, সাংবাদিক এ বি এম মূসা, নায়করাজ রাজ্জাককে সম্মাননা জানিয়েছিল বাংলাদেশ প্রতিদিন। আজ সাংবাদিকতা, বাংলা সাহিত্য ও বাংলা ভাষায় অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ প্রতিদিন এই প্রথিতযশা ব্যক্তিত্বকে আজীবন সম্মাননা জানাচ্ছে।
কালের কণ্ঠ'র সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন বলেন, দু'জন জীবন্ত কিংবদন্তিকে আমাদের মাঝে পেয়ে আমরা ভাগ্যবান। একজন সাংবাদিকতার শিরোমনি আবদুল গাফফার চৌধুরী, অন্যজন বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান। দু'জনই তাদের ক্ষেত্রে জীবন্ত কিংবদন্তি। বাঙালি জীবনে দু'টি শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতের একটি 'আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি' রচনা করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অন্যটি 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি' রচনা করেছেন আবদুল গাফফার চৌধুরী। বাঙালি জাতি যতদিন আছে ততদিন এ গান থাকবে। তিনি বলেন, গাফফার চৌধুরী শুধু সাংবাদিক নন, তিনি বাংলা সাহিত্যেরও একজন বড় লেখক। তার অনেক গল্প-উপন্যাস আছে। 'সম্রাটের ছবি' বলে তার একটি বিখ্যাত বই আছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি দেশ পত্রিকায় লিখেছেন 'কেয়া আমি ও জার্মান মেজর', যা মুক্তিযুদ্ধের অসামান্য গল্প। বাংলাদেশ প্রতিদিন আপনাকে সম্মাননা জানাচ্ছে, সেটি আমাদের সবার জন্য অনেক গর্বের বিষয়। ইস্ট-ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের প্রতিটি কর্মী আজ আপনাকে সম্মাননা জানাচ্ছি।
ডেইলি সান'র ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক আমির হোসেন বলেন, আন্তর্জাতিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে গাফফার চৌধুরীর লেখা বড় অবদান রেখেছে। জাতির প্রয়োজনে যখনই দরকার হয়েছে, তিনি অসীম সাহস নিয়ে লিখেছেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে গাফফার চৌধুরী প্রথম লন্ডন থেকে পত্রিকা বের করে সে সম্পর্কে লিখেছেন। তিনি বঙ্গবন্ধু, বাঙালি জাতির পক্ষে কলম ধরেছেন। তাকে সম্মাননা জানাতে পেরে আমরা গর্বিত।
বিডি-প্রতিদিন/ফারজানা/এস আহমেদ