যখন বিরোধী দলে ছিলেন, তখন ভোটের মৌসুমে পান থেকে চুন খসলেই নির্বাচন কমিশনে গিয়ে নালিশ ঠুকতেন রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে। ফিরিস্তি দিয়ে বলতেন, কোন কোন পুলিশ অফিসার বা আমলা 'পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ' করছেন! অথচ সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই এখন উল্টো সুরে গাইছেন। পক্ষপাতমূলক আচরণের অভিযোগে নির্বাচন কমিশন কয়েকজন পুলিশকর্তা ও আমলাকে সরানোর নির্দেশ দিতেই রেগে আগুর হয়ে গেলেন পশ্চিমবঙ্গের এই মুখ্যমন্ত্রী।
গতকাল সোমবার হুগলি জেলার পাণ্ডুয়ায় একটি জনসভায় গিয়ে মমতা বললেন, 'সবই ষড়যন্ত্র। একজন অফিসারকেও সরাবো না।' এর জেরে স্বাভাবিকভাবেই নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংঘাতে জড়িয়ে পড়ল রাজ্য সরকার।
উল্লেখ্য, গত রবিবার কলকাতায় গিয়েছিলেন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার ভি এস সম্পত। রাজ্যের সার্বিক পরিস্থিতি খতিয়ে দেখেন তিনি। তখনই সিপিএম, কংগ্রেস, বিজেপি, আরএসপি ইত্যাদি রাজনীতিক দলের তরফে অভিযোগ করা হয়, 'ছয়টি জেলার পুলিশ সুপার এবং একটি জেলার জেলাশাসক নিরপেক্ষভাবে কাজ করছেন না। নির্বাচনী বিধি ভেঙে শাসক দলকে নানাভাবে সুবিধে পাইয়ে দেওয়া হচ্ছে।'
যে পুলিশ সুপারদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠেছে তারা হলেন- পশ্চিম মেদিনীপুরের ভারতী ঘোষ, বাঁকুড়ার মুকেশ, নদীয়ার সব্যসাচী মিশ্র, বর্ধমানের সৈয়দ মহম্মদ হোসেন মির্জা, মুর্শিদাবাদের হুমায়ুন কবীর এবং উত্তর ২৪ পরগনার তন্ময় রায় চৌধুরী।
এ ছাড়াও উত্তর ২৪ পরগনার জেলাশাসক সঞ্জয় বনশলের বিরুদ্ধে পক্ষপাতমূলক আচরণের অভিযোগ আনে বিরোধীরা। একইভাবে কেশপুর, আলিপুরদুয়ার, হাড়োয়া, হরিশচন্দ্রপুর, ক্যানিং থানার ওসিদের বিরুদ্ধেও পক্ষপাতদুষ্ট কাজকর্মের অভিযোগ ওঠে।
অভিযোগের ভিত্তিতে ২৪ ঘণ্টার ভিতর তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয় নির্বাচন কমিশন। অভিযুক্ত সবাইকে সরানো না হলেও কাউকে কাউকে সরানোর নির্দেশ দেওয়া হয়।
সোমবার কমিশনের তরফে জানানো হয়, পাঁচটি জেলার পুলিশ সুপার, একটি পুলিশ জেলার পুলিশ সুপার, একজন জেলাশাসক এবং দু'জন অতিরিক্ত জেলাশাসককে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এরা ভোটের কাজের সঙ্গে কোনওভাবে যুক্ত থাকতে পারবেন না। মঙ্গলবারের মধ্যে এই নির্দেশ কার্যকর করতে রাজ্য প্রশাসনকে নির্দেশ দেয় নির্বাচন কমিশন।
আর এতেই রাগান্বিত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। হুমকি দিয়ে গলা চড়িয়ে মুষ্টি আস্ফালন করে তিনি বলেন, 'রাজ্যকে না জানিয়ে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। গায়ের জোরে তা মানতে বাধ্য করানোর চেষ্টা হচ্ছে। এ সব চলবে না। একজন অফিসারকেও সরাবো না। নির্বাচন কমিশন আমায় গ্রেফতার করুক। আমি নির্বাচন কমিশনকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছি। আমি ইস্তফা দিয়ে দেব। দেখব, নির্বাচন কমিশন কীভাবে রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভার নেয়। যদি জঙ্গলমহলে ফের আগুন জ্বলে, তার দায় আমি নেব না।'
এমনকী, নির্বাচন কমিশনের কাজকর্মেও ষড়যন্ত্রের ছায়া দেখেছেন তিনি!
ওয়াকিবহাল মহলের মতে, পশ্চিমবঙ্গে প্রশাসন স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করে, এই দাবি করে আসছে বর্তমান রাজ্য সরকার। কিন্তু এখন নির্বাচন কমিশনের পদক্ষেপে প্রমাণ হচ্ছে, সেই দাবি আদৌ সত্যি নয়। আর একে 'প্রেস্টিজ ইস্যু' করে নিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাই তার এত রাগ!
কিন্তু সংবিধানের শপথ নেওয়া সত্ত্বেও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখন সংবিধানই মানছেন না বলে অভিযোগ আইনজ্ঞ মহলের। সংবিধানের ৩২৪ ধারা অনুযায়ী, সংসদ এবং রাজ্য বিধানসভা নির্বাচন-সংক্রান্ত বিষয়ে যাবতীয় ক্ষমতা ভোগ করে নির্বাচন কমিশন।
১৯৭৮ সালে মহিন্দর সিং গিল বনাম মুখ্য নির্বাচন কমিশনার মামলায় সুপ্রিম কোর্ট বলেছিলেন, স্বচ্ছ নির্বাচনের স্বার্থে নির্বাচন কমিশন যদি কোনও পদক্ষেপ নেয়, তবে তাকে প্রশাসন চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে না। সুতরাং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য সংবিধান লঙ্ঘনের শামিল।
এদিকে, নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে যাদের সরানো হলো তারা হলেন- উত্তর ২৪ পরগনার জেলাশাসক সঞ্জয় বনশলকে সরিয়ে আনা হচ্ছে ওঙ্কার সিং মিনাকে। পশ্চিম মেদিনীপুরের অতিরিক্ত জেলাশাসক অরিন্দম দত্তকে সরিয়ে আনা হচ্ছে বৈভব শ্রীবাস্তবকে। পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার ভারতী ঘোষকে সরিয়ে আনা হচ্ছে এস ঝাঁঝোরিয়াকে। মুর্শিদাবাদের পুলিশ সুপার পদ থেকে হুমায়ুন কবীরকে সরিয়ে তার জায়গায় আনা হচ্ছে সৈয়দ ওয়াকার রাজাকে।
বর্ধমানের পুলিশ সুপার সৈয়দ মহম্মদ হোসেন মির্জার জায়গায় আসবেন মীরজ খালিদ। মালদহের পুলিশ সুপার রাজেশ যাদবের জায়গায় আনা হবে রূপেশ কুমারকে। ঝাড়গ্রাম পুলিশ জেলার সুপার পদে আনা হবে অলোক রাজোরিয়াকে। তিনি এতদিন বীরভূমের পুলিশ সুপার ছিলেন। তার জায়গায় বীরভূমের পুলিশ সুপার হচ্ছেন রশিদ মুনির খান।