বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ের গেটে লীগ সরকার একবার তালা লাগাচ্ছে আবার খুলছে। লীগ সরকার বললাম এ কারণে যে, সরকারের সিদ্ধান্ত ছাড়া পুলিশ এমন কাজ নিশ্চয়ই করছে না। আমাদের সংবিধানের ৩৬ অনুচ্ছেদে বলা আছে, 'জনস্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে বাংলাদেশের সর্বত্র অবাধ চলাফেরা... করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।' বেগম খালেদা জিয়ার এই সাংবিধানিক অধিকার খর্ব করেছে সরকার। ৫ জানুয়ারির পর একবার নয়, একাধিকবার এই বেআইনি ও অরুচিকর কাজটি হয়েছে। ২০১৩ সালের ২৯ ডিসেম্বরও বেগম জিয়াকে একই কায়দায় তার বাসভবনের গেটে তালা লাগিয়ে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। সেদিন তিনি ঢাকায় 'মার্চ ফর ডেমোক্রেসি'র ডাক দিয়েছিলেন। কোনো প্রকার সভা-সমাবেশে যাতে তিনি যোগদান করতে না পারেন সে জন্যই সরকার ওই অন্যায় ব্যবস্থাটি নিয়েছিল। সেদিনের 'মার্চ ফর ডেমোক্রেসি'র ঢাকা সমাবেশ সফল করতে পারেনি বিএনপি এবং তার মিত্ররা। জোটে দলের সংখ্যা অনেক, তখন ছিল ১৮ এখন ২০। কোনো দেশে স্বৈরতন্ত্র বা একনায়কতন্ত্রবিরোধী গণতান্ত্রিক সংগ্রামে এ ধরনের বড় ছোট দল নিয়ে বৃহৎ জোট গঠনের একটা রাজনৈতিক মূল্য অবশ্যই আছে। বৃহত্তর ও মহত্তর কোনো সংগ্রামে অনেক ব্যক্তিবিশেষও কখনো কখনো অনেক বড় ভূমিকা বা অবদান রাখতে পারেন। ২০ দলীয় জোটের মধ্যে মাঠের লড়াইয়ে বিএনপি ছাড়া জামায়াতে ইসলামীই কিছু করতে সক্ষম হলেও ২০১৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর তারাও কোনো ভূমিকা রাখেনি। এবার ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারির কর্মসূচিতেও সাংগঠনিক শক্তির তুলনায় জামায়াতিদের ভূমিকা একেবারেই নগণ্য।
৫ জানুয়ারি এখন শুধু বাংলাদেশেই আলোচিত ঘটনা নয়। গণতান্ত্রিক বিশ্বে ৫ জানুয়ারি উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে দিয়েছে। লীগ সরকারের এবারের ভূমিকা আরও ন্যক্কারজনক। বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান অফিসেই শুধু নয়, তাদের নয়াপল্টনস্থ কেন্দ্রীয় কার্যালয়েও তালা ঝুলিয়ে দিয়ে শত শত পুলিশের পাহারা বসানো হয়েছে। প্রস্তুত ছিল সাঁজোয়া গাড়ি, জলকামান ইত্যাদি। বেগম জিয়ার গুলশান কার্যালয়ের সামনে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সশস্ত্র সদস্যের সাজ সাজ 'রণপ্রস্তুতি' দেখে মনে হয়েছে এই বুঝি যুদ্ধ শুরু হলো! এবার আর দুই ট্রাক নয়, গোনে গোনে তেরো ট্রাক। শুধু বালুর ওপরও ভরসা রাখতে পারেনি অবরোধকারী সরকারি বাহিনী, কয়েক ট্রাক ইটও এনে রেখেছিল। সঙ্গে জলকামানসহ অন্যান্য প্রস্তুতি তো ছিলই। কিন্তু কেন? বেগম খালেদা জিয়া তো 'কাগুজে বাঘ' বা সরকারি দলের কারও কারও ভাষায় 'মিডিয়া টাইগার'। তো এই কাগুজে বাঘ বা মিডিয়া টাইগার একজন বেগম জিয়াকে মোকাবিলার জন্য এমন যুদ্ধ প্রস্তুতি কেন? নয়াপল্টনে বিএনপি অফিসের সামনে দিয়ে কাকপক্ষি উড়ে যেতেও সরকারি বাহিনী রাইফেলের ট্রিগারে আঙ্গুল দিয়েছে। এত ভয়! বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান অফিসের সামনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কী সভ্যতা বর্জিত কাজ করেছে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সুবাদে দেশ-বিদেশের মানুষ তা সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছে। যা ঘটেছে তা লজ্জার, নিন্দার। বেগম খালেদা জিয়াকে বেরই হতে দেওয়া হয়নি। শুধু তাই নয়, বেরুতে না পেরে ভিতরে গাড়ির পা-দানিতে দাঁড়িয়ে তিনি যখন সাংবাদিকদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখছিলেন, তার ওপর মানবদেহের জন্য মারাত্দক ক্ষতিকর পিপার স্প্রে নিক্ষেপ করা হয়। অসহ্য জ্বালায় বারবার কাশিতে তার বাক রুদ্ধ হয়ে আসছিল, ছটফট করছিলেন তিনি এবং এক সময় অসুস্থও হয়ে পড়েন। শোনা যাচ্ছে, এখনো সেই ধকল সইছেন তিনি।
ভারতের বহুল প্রচারিত আনন্দবাজার পত্রিকা তাদের সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলেছে, 'কার্যত জরুরি অবস্থা কায়েম করেছেন হাসিনা।' তাতে বলা হয়, 'বাংলাদেশ অবশ্যই দরিদ্র দুনিয়ায় গণতন্ত্র অনুশীলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ। কিন্তু সে কারণেই সে দেশে গণতন্ত্র যেভাবে খণ্ডিত হচ্ছে তাতে উদ্বেগের বড় কারণ আছে। এক বছর আগের নির্বাচন বিরোধীরা বয়কট করলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তাতে বিজয়ী হয়। বিরোধী বিএনপি ওই নির্বাচনের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে সারা দেশে প্রতিবাদ সমাবেশের ডাক দিলে তা বানচাল করতে হাসিনা ওয়াজেদের সরকার গোটা দেশে কার্যত জরুরি অবস্থার অনুরূপ নিরাপত্তার কড়াকড়ি আরোপ করে, বিরোধী দলনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে তারই নিরাপত্তার নামে কার্যত অন্তরীণ করা হয়। প্রতিবাদী আন্দোলন উত্তাল হইয়া উঠিয়াছে।... বিএনপি নেতৃত্ব যদি তাহার বয়কট করা নির্বাচনকে অবৈধ আখ্যা দিয়া প্রতিবাদ জানাইতে চায় এবং নতুন করিয়া নিরপেক্ষ তদারকি সরকারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচনের নামে আন্দোলনে নামে, তবে তাহা নিষিদ্ধ করা ও নেতাদের গ্রেফতার করা কেমন গণতন্ত্র?'
এদিকে যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী ম্যাগাজিন 'দ্য ইকোনমিস্টে' 'ড্রামা কুইন্স' শিরোনামে এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'ফের বাংলাদেশে দুই বেগমের লড়াই শুরু হয়েছে। এর মূল্য দিতে হচ্ছে দেশকে। দেশে রাজনীতির গতিপথ দেখে মনে হচ্ছে, এ বছরটি এমনই চলবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তিনি আগামী নির্বাচনের আগে বিএনপিকে ধ্বংস করে দিতে চান। বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার মৌলিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এতে দেশের নিরপেক্ষ ভোটারদের সহানুভূতি বাড়ছে তার প্রতি। বাংলাদেশে এ অবস্থার দৃশ্যত কোনো সমাধান নেই। ৫ জানুয়ারি ফের ঢাকার রাজপথে দেখা মিলেছে বালুভর্তি বর্ণিল ট্রাক। এ দিনটি ছিল মারাত্দক ত্রুটিপূর্ণ সাধারণ নির্বাচনের প্রথম বছর।... আওয়ামী লীগ অর্থনৈতিক যে দক্ষতার দাবি করে তা অপ্রাসঙ্গিক হতে শুরু করেছে। খালেদা জিয়ার মৌলিক অধিকার কেড়ে নেওয়া ও তাকে খেয়ালখুশি মতো অবমাননার কারণে নিরপেক্ষ ভোটাররা তার দিকেই ঝুঁকছেন।'
বাইরে এমন অনুকূল জনমত গড়ে ওঠার মধ্যে আমেরিকার ছয় কংগ্রেসম্যানের ফলস স্টেটমেন্ট ও খালেদা জিয়া-অমিত শাহ্ টেলিফোন আলাপের কাহিনী প্রচার বিএনপির জন্য কী খুব জরুরি ছিল? বেগম জিয়ার বোঝা উচিত যারা এসব করেছে, তারা সেবোটেজিয়ার। এদের ব্যাপারে তার ভাবা উচিত।
লীগ সরকার, শাসক লীগ এবং তাদের ধামাধরা বিটিম, সিটিম ইনুপন্থি জাসদ ও মেননপন্থি ওয়ার্কার্স পার্টির সঙ্গে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটসহ অন্য সব সরকারবিরোধী দলসমূহের বিরোধ বেঁধেছে ৫ জানুয়ারি 'গণতন্ত্রের বিজয় দিবস' এবং 'গণতন্ত্র হত্যা দিবস'-এর কর্মসূচি নিয়ে। ৫ জানুয়ারির লড়াইটা মূলত ছিল ক্ষমতার লড়াই। নবম সংসদে দানবীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে বদলে দিয়ে এবং নানা ছলচাতুরি ও প্রশাসনযন্ত্রকে ব্যবহার করে ক্ষমতার নাটাই লীগ সরকার নিজেদের হাতে রেখে দিয়েছে। সংবিধানের দোহাই দিয়ে তারা 'বজ্র কণ্ঠে' বলছে, তাদের সিংহাসন লাভ বা ক্ষমতারোহণ বৈধ। কিন্তু সর্বদল সমর্থিত একটি সাংবিধানিক পদ্ধতি একদলীয় সিদ্ধান্তে বদলে দেওয়ার অনৈতিকতার কথা তারা এবং তাদের পক্ষে পত্র-পত্রিকা এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় 'ঢোল পেটানো' 'দলদাসরা' নানাভাবে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনটি ছিল একটি একপক্ষীয়, পাতানো এবং ভোট ছাড়াই আসন ভাগাভাগির নির্বাচন। ৩০০ আসনের সংসদে ১৫৩ আসনে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে কোনো নির্বাচনই হয়নি। অথচ আমাদের সংবিধানের ৬৫(২) অনুচ্ছেদে এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট বাধ্যবাধকতা আছে। তাই এ নির্বাচন ও সংসদ এবং তার ওপর দাঁড়িয়ে গঠিত সরকারের বৈধতার প্রশ্নটি তুলেছে বিএনপি ও অন্যরা। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার কথা বলছে সরকার পক্ষ। প্রতিপক্ষ বলছে, সংসদ গঠনের প্রক্রিয়া নিয়ে সংবিধানের নির্দেশ (৬৫(২)-একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকাসমূহ হইতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আইনানুযায়ী নির্বাচিত তিনশত সদস্য লইয়া এবং এই অনুচ্ছেদের (৩) দফার কার্যকরতাকালে উক্ত দফায় বর্ণিত সদস্যদিগকে (সংরক্ষিত মহিলা আসন) লইয়া সংসদ গঠিত হইবে; সদস্যগণ সংসদ-সদস্য বলিয়া অভিহিত হইবেন) অমান্য করেছে সরকার। সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন করেছে। তাই এই নির্বাচন বৈধ হয়নি। বিষয়টি একেবারেই স্পষ্ট বলে মনে হয়। প্রাবন্ধিক ফরহাদ মযহার ব্যারিস্টার রফিক-উল হককে উদ্ধৃত করে গত ৯ জানুয়ারি প্রকাশিত এক লেখায় মন্তব্য করেছেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন, বর্তমান সংসদ ও সরকার প্রশ্নে বিএনপিসহ অন্য সরকারবিরোধী দলসমূহের অবস্থান যুক্তিযুক্ত। দশম সংসদ নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, এই নির্বাচন নিয়ম রক্ষার নির্বাচন, এই নির্বাচন শেষেই দ্রুত একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে সংলাপ হবে; অর্থাৎ ব্যবস্থা হবে। এখন তিনি কথা ফিরিয়ে নিয়েছেন। বলছেন ২০১৯ সালের আগে কোনো নির্বাচন নয়। এমন কী কোনো আলোচনাও নয়।
আমার মনে হয়, বর্তমান সংঘাত-সংক্ষুব্ধ পরিস্থিতির উদ্ভব এখান থেকেই। এক বছর রাজনৈতিক পরিস্থিতি বেশ শান্তই ছিল বলা চলে। লীগ সরকারের লোকজন উপহাস করে বলেছে, কিছু করার ক্ষমতা বিএনপির নেই। বিএনপি চেয়ারপারসন বলেছেন, সমঝোতার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য তারা সরকারকে এক বছর সময় দিয়েছেন। এ ব্যাপারে সত্যি যাই হোক, বর্তমান সত্য হচ্ছে, বেগম জিয়া লীগ সরকারকে আর সময় দিতে চান না, শেখ হাসিনা এবং তার সরকারও বেগম জিয়া, তার দল ও জোটকে দেখে নিতে চান। উভয় পক্ষের দেখে নেওয়ার রাজনীতি এর আগে আরেকবার হয়েছিল ১৯৯৪-৯৬ সালে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার দাবিতে বেগম জিয়ার বিএনপি সরকারকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিল শেখ হাসিনার নেতৃত্বে লীগ-জামায়াত-এরশাদের জাতীয় পার্টি। হেরেছিলেন বেগম জিয়া, হেরেছিল বিএনপি। '৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো একটা একপক্ষীয় নির্বাচন করে ১৫ দিনও সেই সংসদ টেকাতে পারেনি বিএনপি; তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাও মানতে বাধ্য হয়েছিল। ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি নিয়ে রাজনৈতিক মহলে আলোচনা চলছে, এবার জিতল কে? ৫ জানুয়ারি ছিল পারস্পরিক চ্যালেঞ্জ-পাল্টা চ্যালেঞ্জ। তবে এটা বলে নেওয়া দরকার যে, ৫ জানুয়ারি উভয় পক্ষের লক্ষ্য ছিল দুটি- এক. তাৎক্ষণিক (ইমিডিয়েট), দুই. চূড়ান্ত (আলটিমেট)। রাজনীতির এই চূড়ান্ত খেলার হার-জিৎ নিয়ে আগাম মন্তব্য না করাই এখন উত্তম। তবে ৫ জানুয়ারির জয়-পরাজয় নিয়ে মন্তব্য করাই যায়। এক কথায় বলতে গেলে, সেদিন শাসক লীগ ও লীগ সরকার পরাজিত হয়েছে। ঘটনা বিশ্লেষণ করলে এটাই স্পষ্ট হয় যে, বেগম খালেদা জিয়াকে সেদিন জনসভা করার অনুমতি দিলে তাতে তিনি যতটা লাভবান ও সরকার যতটা ক্ষতিগ্রস্ত হতো, অবরুদ্ধ করে বেগম জিয়াকে জনসভা করতে না দেওয়ায় তিনি বেশি লাভবান ও সরকার অধিকতর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সরকার সেদিন গৃহীত পদক্ষেপের মাধ্যমে দেশে-বিদেশে সর্বত্র (দলীয় লোকজন ও বেনিফিশিয়ারিরা ছাড়া) তার অগণতান্ত্রিক চরিত্রই উন্মোচন করেছে। সভা-সমাবেশের স্বাধীনতা বাংলাদেশের সংবিধানেই স্বীকৃত। ৩৭ অনুচ্ছেদে স্পষ্ট করে বলা আছে, 'জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হইবার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।' বিএনপি চেয়ারপারসন নিজে এবং তাদের দলের অন্য দায়িত্বশীলরা বলেছেন তারা শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি পালন করবেন। কিন্তু তাদের অনুমতি দেওয়া হয়নি। সভা-সমাবেশ করার বিষয়টি কোনো কর্তৃপক্ষীয় করুণার বিষয় নয়, এটা ব্যক্তি বা সংগঠনের অধিকার। বিএনপিকে এই অধিকার ভোগ করতে বাধা দিয়ে সরকার অন্যায় করেছে বলেই প্রতিভাত হয়। দৃষ্টিকটু এবং নিন্দনীয় বিষয় ছিল, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দাবড়ে বিএনপি ও তার মিত্ররা স্বাধীনভাবে রাজপথে নামতে পারেনি, সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করেছিল ডিএমপি; কিন্তু শাসক লীগের বিভিন্ন বাহিনী-সংগঠন ঠিকই রাস্তায় ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাহারায়। এটাও সরকারের অগণতান্ত্রিক চরিত্রই স্পষ্ট করেছে। বিএনপি জনসভা করতে পারেনি, শাসক লীগও ডিএমপির নিষেধাজ্ঞার ঢাল ব্যবহার করে নিজেদের কর্মসূচি বাতিল করেছে। অর্থাৎ তারাও প্রধানমন্ত্রীর সভা করতে শঙ্কায় ছিল। আইনের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সভা করেনি বলা হলেও আসলে ওইদিন জনরোষের ভয়টাই সরকারি দলে বেশি কাজ করেছে বলে বলছেন অনেকে। সে জন্য সরকারি-বেসরকারি এত বাহিনী থাকা সত্ত্বেও জনসভার ঝুঁকি নেয়নি শাসক লীগ। ৫ জানুয়ারি ২০১৫ কিন্তু ২০১৩ সালের ২৯ ডিসেম্বরের মতো ছিল না। বিএনপির লোকজন মাঠে নামেনি, এ কথা এবার বলা যাচ্ছে না। জনসভা করতে পারেনি তারা কিন্তু রাস্তায় ছিল কম-বেশি। প্রচণ্ড প্রতিবন্ধকতার মুখে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে দেখা গেছে তাদের লোকজন। ঢাকার বাইরের জেলাসমূহ তো কাঁপিয়েছে বিএনপির লোকেরা। এখানে বলা দরকার, জামায়াত এই কর্মসূচিতেও খুব একটা মাঠে নামেনি। বিএনপি মোটামুটি একাই লীগ সরকারের নীতিনির্ধারকদের কপালে ভাঁজ ফেলে দিয়েছিল। ৫ জানুয়ারি বিএনপি বোধহয় এমন একটা আশাজাগানিয়া বার্তা জনগণকে দিতে পেরেছে যে, তারা পারে। সেদিন তারা প্রশংসিত হয়েছে আর দেশ-বিদেশে নিন্দা কুড়িয়েছে শাসক লীগ ও সরকার। তবে এবারও দলের সিনিয়র-জুনিয়র নেতাদের মাঠে দেখা যায়নি। হ্যাঁ, কিছু গুরুত্বপূর্ণ নেতা আছেন, আন্দোলন পরিচালনার জন্য, যাদের সাবধানে থাকা দরকার। কিন্তু সেই রকম নেতা কজন? বাকিরা কোথায়?
৫ জানুয়ারি বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট চ্যালেঞ্জ বাউটে নেমেছে বলেই মনে হয়। বেগম খালেদা জিয়া এখনো অবরুদ্ধ। প্রধানমন্ত্রী, অন্যান্য মন্ত্রী ও নেতা বেগম জিয়া অবরুদ্ধ নন বলে যে ঘোষণা বার বার দিচ্ছেন তা যে সত্য নয় তা তো বোঝা যায় বার বার তার কার্যালয়ের গেটে তালা লাগানো থেকে। বেগম জিয়া চাইলে তার বাসায় যেতে পারেন, এতেও বোঝায় না যে, তিনি অবরুদ্ধ নন। তিনি তার দলের নয়াপল্টন অফিসে বা অন্য কোথাও যেতে পারছেন না বা পারবেন না কেন? 'কাগুজে বাঘ'র ভয়ে যে সরকার অনেকটাই ভীত হয়ে পড়েছে তা বোঝা যাচ্ছে সারা দেশে গ্রেফতার অভিযান থেকে। কঠোর অবস্থান ও নানা ব্যবস্থা গ্রহণের পরও বেগম জিয়া আহূত অনির্দিষ্টকালের অবরোধ ভাঙতে পারছে না সরকার। মনে হচ্ছে, গণতন্ত্র ও দেশের সংবিধানের শর্ত পূরণে সরকারকে বাধ্য করে সবার অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি অর্থবহ, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের অমীমাংসিত বিষয়ের চূড়ান্ত ফায়সালার লড়াই-ই শুরু করেছে ২০ দলীয় জোট। ইতিমধ্যে বিকল্পধারাসহ আরও কিছু সংগঠন ও ব্যক্তির সমর্থন থেকে মনে হয়, সরকারবিরোধী চলমান আন্দোলনের পক্ষে সমর্থন আরও বাড়বে এবং লীগ সরকার 'একঘরে' হয়ে পড়বে।
পরিস্থিতি বলছে, উদ্ভূত সংকট মোকাবিলায় সরকার দিন দিন তার সক্ষমতা হারাচ্ছে। জনমত ও জনগণ জেগে উঠলে কোনো অনুগত বাহিনী কাজে লাগে না। তারাও মত ও পথ বদলায়। সরকার এবং বিরোধী পক্ষের উচিত হবে, দেশকে দীর্ঘস্থায়ী রক্তক্ষয়ী সংঘাতের দিকে ঠেলে না দিয়ে সংলাপের মধ্যমে একটা শান্তিপূর্ণ সমাধানে পৌঁছানো। সময় যত বেশি যাবে ক্ষত ও ক্ষতি তত বাড়বে।
এর পরও কথা আছে। সমাধান যদি হতে হয় সমঝোতা হবে কার সঙ্গে? বিএনপির সঙ্গে শাসক লীগের বা ২০ দলীয় জোটের সঙ্গে মহাজোট সরকারের? তা হলে তো একদল বা এক জোটের জায়গায় আরেক দল ও জোট প্রতিস্থাপিত হবে। তাতে দেশ ও জনগণের কী লাভ? বিষয়টা এখন থেকেই ভাবা দরকার এ কারণে যে, উভয় পক্ষকেই জনগণের দেখা আছে। জনগণের আস্থা অর্জনের জন্য বিএনপি নেত্রীকে তার দলের ও জোটের বাইরের দেশপ্রেমিক, গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল অন্যান্য দল, সংগঠন, প্রতিষ্ঠান এমন কী ব্যক্তিবিশেষের সঙ্গেও আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া উচিত। যে কোনো সমঝোতা উদ্যোগে সংশ্লিষ্ট রাখা উচিত প্রয়োজনীয় ও যোগ্য ব্যক্তিদের। লুটেরা, দুর্নীতিবাজ, দুর্বৃত্ত হিসেবে পরিচিত ব্যক্তি বা ব্যক্তিরা দলীয় বড় পদধারী হলেও তাদের বাদ দেওয়ার ব্যাপারে অঙ্গীকার থাকা দরকার। মানুষ শান্তি-নিরাপত্তা চায়, গণতন্ত্র ও সুশাসন চায়, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি চায়। এসবই মহৎ কাজ। অসৎ লোক দিয়ে কিন্তু মহৎ কাজ হয় না।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।
ই-মেইল : [email protected]